খাদ্যের জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে

৯ মার্চ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক বক্তৃতায় বাংলাদেশ সফররত নোবেলজয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানী রিচার্ড জন রবার্টস বলেছেন, জিনগত পরিবর্তন করা ফসল উদ্ভাবন ও প্রসারে বাংলাদেশ নেতৃত্বের আসনে আছে।

এ দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিচাহিদা পূরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই বিজ্ঞানীর মতে, জিনগত পরিবর্তন করা ফসল নিয়ে অনেক মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা থাকলেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। তিনি জিনগত পরিবর্তন করা ফসল ও খাদ্যের সঙ্গে প্রথাগত প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত ফসলের তুলনা করেন কারও বাসে চড়ে যাওয়া এবং উড়োজাহাজে ভ্রমণের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশে জিনগত পরিবর্তন করা ‘বিটি বেগুনে’র বিস্তার ও ‘গোল্ডেন রাইসে’র চাষ শুরু করার জন্য অভিনন্দন জানান।

সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্য ও কৃষিসংক্রান্ত জিনগত সম্পদ কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য প্রতিবেদন ২০১৯’–এ উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবেশব্যবস্থায় কৃষি ও খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত জীববৈচিত্র্যের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতি সংকুচিত হচ্ছে। মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন যাপনের জন্য জীববৈচিত্র্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু খাদ্যের জোগান নয়; নির্মল বাতাস, পানি, ওষুধ, বাসস্থান, পরিধেয় বস্ত্রসহ জীবন বাঁচাতে ও তাকে সাজাতে যা কিছু দরকার, সেসবের জোগান আসে জীববৈচিত্র্যময় পরিবেশ থেকে।

পৃথিবীতে মানুষের চাহিদার জোগান দিতে কৃষি উৎপাদনের বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে। সে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, পৃথিবীতে উৎপাদিত ফসলের দুই–তৃতীয়াংশই ৯ প্রজাতির খাদ্যপণ্য (ধান, গম, ভুট্টা, আখ, আলু, সয়াবিন, পাম অয়েল বীজ, চিনি উৎপাদন উপযোগী বিট ও কাসাভা)। চাষযোগ্য আরও প্রায় ছয় হাজার কৃষিপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ঝোপ-জঙ্গলে, বিরান ভূমিতে যেসব বুনো খাবার উপাদান খুঁজলে পাওয়া যেত, সেগুলো ক্রমেই বিরল বা বিলুপ্ত হয়েছে।

বিজ্ঞানীদের হিসাবে, ৫০ বছর আগেও প্রকৃতিতে খাদ্য উপাদানের যত বৈচিত্র্য ছিল, এখন তা অনেকাংশে সংকুচিত হয়েছে। একই সময়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে এবং প্রায় একই ধরনের খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। অধিকাংশ দেশে মানুষের খাদ্যতালিকায় এখন চাল, আটা, আলু ও চিনিনির্ভর খাদ্যই প্রধান। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চাল, গম ও ভুট্টা সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর মানুষের প্রায় ৫১ শতাংশ ক্যালরির জোগান দেয়।

প্রকৃতির কোনো বিপর্যয়ে অল্প কিছু এলাকায় ফসলহানি ঘটলে পৃথিবীজুড়েই তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ১৮৪০ সালে আয়ারল্যান্ডে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আলুর মড়ক। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে আবহাওয়ার কারণে যদি ভুট্টা উৎপাদনে বড় ক্ষতি হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্য সরবরাহে তার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক হবে।

কেননা, বিশ্বের শীর্ষ ভুট্টা উত্পাদক এই দুটি দেশ। ২০১৬ সালে আফ্রিকার জাম্বিয়া, কঙ্গো, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কারে একযোগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুট্টার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে দ্রুত নগরায়ণ, কৃষিজমির সংকোচন, রাসায়নিক ও ক্ষতিকর বর্জ্যের আধিক্যে পরিবেশে দূষণ বাড়ছে। ফলে মানুষের খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। মাঠ, বন, জলাশয়, নদ-নদী থেকে মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে যে ভারসাম্যের পরিবেশ দরকার তা বিনষ্ট হচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ২০ শতাংশ সবুজ এলাকায় এখন আগের তুলনায় অনেক কম ফসল উৎপাদিত হয়। মৌমাছিসহ অন্যান্য পতঙ্গ ও পাখি, যারা পরাগায়নে সহায়তা করে ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করে, তাদের সংখ্যা কমছে। ফসলি জমির অতি ব্যবহারের ফলে উদ্ভিদ, অণুজীব ও প্রাণিবৈচিত্র্য সংকুচিত হচ্ছে।

ফলে মানুষের খাদ্য জোগানের ফসলের টেকসই উৎপাদন ও বৃদ্ধি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি এবং ক্রমাগত সংকোচনের ফলে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের সংকট ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। জীববৈচিত্র্যের সংকোচনের সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবহারেরও সম্পর্ক রয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক ইতিমধ্যে জানা বিষয়। জীববৈচিত্র্য প্রতিবেশব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। প্রকৃতিতে ছোট-বড় নির্বিশেষে জীব–অণুজীবের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিকভাবে জীবজগতের সব সদস্যের টেকসই বিকাশে সহায়তা করে। মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের জটিল আন্তসম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে মানুষের আয়ত্তে এসেছে, এমন কথা বলা অতিকথন।

মানুষের খাদ্য ও জীবনযাপনের উপকরণের অবিরাম জোগান নিশ্চিত করতে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশি বেশি ফসল উৎপাদনের কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রায় উপেক্ষিত হচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল হিগিন্স ডাবলিনে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি কনফারেন্সে’ দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, গত ৫০ বছরে পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ স্তন্যপায়ী, পাখি, মাছ ও সরীসৃপ বিলুপ্ত হয়েছে। তিনি বিশ্ববাসীকে ‘বিলুপ্তির সংকট’ থেকে উত্তরণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জীববৈচিত্র্য উপেক্ষা করে খাদ্য উৎপাদনসহ জীবনযাপনের অন্যান উপাদান আহরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে যে ক্ষতি হবে, তা আর কখনো পূরণ করা যাবে না। ফলে একটা সময়ে মানুষের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়তে পারে।

ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক