মারুফ জামানের ফিরে আসা

অপহৃত হওয়ার সাড়ে ১৫ মাস পর সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সেনা কর্মকর্তা মারুফ জামান ফিরে এসেছেন। এটি তাঁর পরিবার, স্বজন তো বটেই; দেশবাসীর জন্যও স্বস্তির খবর। গত কয়েক বছরে অসংখ্য মানুষ অপহৃত হলেও ফিরে এসেছেন খুব কমই। অনেকের হদিস মেলেনি। স্বজনেরা এখনো অপেক্ষায় আছে। মানুষ মারা গেলে অন্তত লাশটি ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু নিখোঁজ হলে স্মৃতি ছাড়া কিছুই থাকে না।

২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বাসা থেকে ছোট মেয়ে সামিহা জামানকে আনতে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিলেন মারুফ জামান। বাসা থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জানা যায়, তিনি বিমানবন্দরে যাননি। এর কয়েক ঘণ্টা পর বাসার ল্যান্ড ফোনে তিনি পরিবারের সদস্যদের জানান যে কয়েকজন লোক বাসায় গেলে যেন তাঁরা তাঁর ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো দিয়ে দেন। পরে কালো টি-শার্ট পরা সুঠামদেহী তিন ব্যক্তি বাসায় এসে তাঁর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ প্রযুক্তি ব্যবহারের জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যায়। আর মারুফ জামান ফিরে এলেন সাড়ে ১৫ মাস বা ৪৬৭ দিন পর।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে—কারা মারুফ জামানকে অপহরণ করেছিল, কেন করেছিল? আবার কেনই–বা ফিরিয়ে দিল? এত দিন তিনি কোথায় ছিলেন? এ রকম ঘটনায় একজন মানুষ ও একটি পরিবারের ওপর কী ভয়াবহ মানসিক আঘাত তৈরি হয়, সেটি কি একবারও আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখেছেন? অপহৃত হওয়ার পর বাসা থেকে যে তিন ব্যক্তি ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল, তাদেরই–বা কী পরিচয়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা প্রয়োজন। মারুফ জামান ফিরে এসেছেন। এত দিন তিনি কোথায় ছিলেন তার রহস্যভেদ যেমন জরুরি, তেমনি অপহরণের পর যাঁরা ফিরে আসেননি, তঁারা কোথায় কী অবস্থায় আছেন, সেই প্রশ্নের সুরাহার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

অপহরণের শিকার হয়ে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাড়ির সামনে বা দূরে কোথাও অপহরণকারীরা রেখে গেছে। এরপর তঁাদের কাছ থেকে কিছু জানা যায় না, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিছু জানাতে পারে না। মারুফ জামানের ক্ষেত্রে কিছু জানা যাবে, সেই আশা করা কঠিন। একে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত এমন একটি ভয়ংকর অপহরণকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে, যারা যেকোনো সময় যাকে খুশি তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে এবং মাসের পর মাস আটকে রাখতে পারে। ফেরত দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি তাদের ইচ্ছাধীন। এই চক্রের টিকিটিও ধরতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা ও পেশাদারির পরিচয় রাখছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ধরনের অপহরণের ক্ষেত্রে পরিবার বা স্বজনদের তরফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে থাকে। তাহলে কি সরষের ভেতরেই ভূত আছে? নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তাদের কেউ কি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে এসব অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভাবমূর্তির স্বার্থেই এ ধরনের অপহরণ ও অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা উচিত।

এভাবে মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো রহস্যভেদ হওয়ার মতো ঘটনা কোনো সভ্য দেশে ঘটতে পারে না। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারের উচিত হবে মারুফ জামানের অপহরণ–রহস্য অবিলম্বে উদ্‌ঘাটন করে দেশবাসীকে অবহিত করা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আর একজন মানুষও যাতে এমন অপহরণ ও গুমের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা।