কেন এ হিংসা-দ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ

খুব বড় রকমের একটি শোকের অবস্থা থেকে বাংলাদেশ বেঁচে গেছে, যদিও পাঁচজন বাংলাদেশি নামাজ আদায় করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কয়েকজন। নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ আল নুর মসজিদে মুসল্লিদের ওপর যে নারকীয় বর্বরতা ঘটেছে, তাতে আমাদের কয়েকজন ক্রিকেটার বলতে গেলে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। আমাদের জন্য সে এক অতি স্বস্তির কথা।

প্রচণ্ড যুদ্ধকাল ছাড়া কোনো ধর্মের উপাসনালয়ে প্রার্থনারত মানুষের ওপর এমন সুপরিকল্পিত আক্রমণ সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। দুটি মসজিদে একই ব্যক্তির হামলায় ৫০ জন মানুষের মৃত্যু অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ধর্মীয় পরিচয়ে আক্রমণের শিকার ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং আক্রমণকারী শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান। এমনটি না হয়ে যদি ঘটনাটি কোনো ধর্মান্ধ মুসলমান ঘটাত খ্রিষ্টান প্রার্থনারত মানুষের ওপর, তাহলেও যেকোনো বিবেকসম্পন্ন মুসলমান বেদনায় কাতর হতো।

কোনো সমাজ বাইরে থেকে যতই মনে হোক অসাম্প্রদায়িক, উদার ও গণতান্ত্রিক, তার ভেতরে যদি প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা না থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। সমাজের ভেতরের অন্তত একটি অংশের মৌন মদদ না থাকলে কেউ সুপরিকল্পিতভাবে এমন কাজ করতে সাহস পাবে না। যতই দূরবর্তী দ্বীপ হোক, সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোক, পশ্চিমের খ্রিষ্টান মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব তার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদৌ নেই, তা ভাবা ঠিক নয়। এ–জাতীয় বর্বরতাকে শুধুই একজন ধর্মান্ধ উন্মাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত নিষ্ঠুর কাজ মনে করা নির্বুদ্ধিতা।

ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষ কোনো কোনো দেশের মানুষের গায়ে লেখা থাকে, কোনো কোনো দেশের মানুষের চামড়ার ভেতরে থাকে। একজনেরটা দেখা যায়, আরেকজনেরটা দেখা যায় না। বিশেষ করে কারও রং যদি ভেজা এঁটেল মাটির মতো কালচে বা বাদামি হয়, তাহলে তার দোষ বেশি। মানুষটা যদি ধবধবে ফরসা হয় এবং ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান না হয়, তার সাত খুন তো বটেই, সত্তর খুন পর্যন্ত হালকাভাবে দেখা হয়।

পশ্চিমের পত্রপত্রিকা পড়লে মনে হবে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী শুধু মুসলমানেরা। মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস ২০১৫-এর ১ ডিসেম্বর বাঙ্গুইতে বলেছিলেন,
মৌলবাদ রোমান ক্যাথলিকসহ সব ধর্মেরই ব্যাধি—আ ডিজিজ অব অল রিলিজিয়নস ইনক্লুডিং রোমান ক্যাথলিক চার্চ। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেন, শুধু ইসলামই একমাত্র ধর্ম নয় যা এই উগ্রতার রোগে আক্রান্ত, আমাদের ক্যাথলিকদের মধ্যেও কিছু—এমনকি বহু মৌলবাদী আছে—উই ক্যাথলিক, উই হ্যাভ আ ফিউ, ইভেন মেনি ফান্ডামেন্টালিস্টস। [এএফপি পরিবেশিত প্রতিবেদন]

ইউরোপের খ্রিষ্টান মৌলবাদীরা নিজেদের মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করা পছন্দ করেন না। তাঁরা একটু নরম শব্দ ব্যবহার করেন। পশ্চিমের দেশগুলোতে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ প্রবল। কোনো কোনো দেশে তাঁরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আছেন, কোনো কোনো দেশে তাঁরা বিরোধী দলে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে পারেন। নিউজিল্যান্ডের নারকীয়তার কয়েক ঘণ্টা পর ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ইউরোপে ‘খ্রিষ্টান সংস্কৃতি’ রক্ষার দাবি জানিয়ে বলেন, তা যদি না করা হয় তাহলে ইউরোপ খ্রিষ্টানদের থেকে মুসলমানদের কাছে চলে যাবে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পরে আল–কায়েদা নামক এক চরম উগ্র মুসলিম গোষ্ঠীর কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে। তারপর থেকে ইউরোপ–আমেরিকার সাধারণ মুসলমানের ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে। বহু দেশের মসজিদে তাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ২০১৭ সালেও কানাডার একটি মসজিদে হামলা করে উগ্রবাদীরা ছয়জনকে হত্যা করে। গত বছর ইতালিতে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ছয় অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। পত্রপত্রিকায় লেখা হয় এসব শ্বেতাঙ্গ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কাজ, খ্রিষ্টান মৌলবাদ কথাটা বলা হয় না।

বহু মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠী যেমন দেশে দেশে সক্রিয়, তেমনি ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলোতে বহু শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। তাদের পরিচালিত ‘হেইট ক্রাইম’–এর কথা প্রচারমাধ্যমে যৎসামান্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাদের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের পরিচয় অপ্রকাশ্য থাকে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর ইসলামি সংগঠনগুলোর নাম বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়, কিন্তু খ্রিষ্টান দেশগুলোতে যেসব মারাত্মক উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, সেগুলোর কথা মানুষ খুব কমই জানে।

জার্মানিতে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁরা অবশ্য অশ্বেতাঙ্গ নন, জার্মানদের মতোই রীতিমতো ফরসা। কিন্তু সেই শ্বেতাঙ্গরা মুসলমান। তাহলে সেই শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে জার্মানির নব্য নাৎসিবাদী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মান’ দলের আক্রোশ কেন? তার অর্থ হলো, শুধু শ্বেতাঙ্গ হলেই হবে না, হতে হবে খ্রিষ্টানও।

ইউরোপ–আমেরিকার আজকের আর্থসামাজিক উন্নতির পেছনে অভিবাসীদের অবদান অত্যন্ত বেশি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফরাসিদেশ প্রভৃতি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে এশিয়া–আফ্রিকার অভিবাসীদের জামাই আদরে গ্রহণ করা হতো। ওই সব দেশে দুই বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিকসংকট ছিল প্রবল। এখন অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হলেও বস্তুত তাদের আক্রোশটা মুসলমানদের ওপর এবং কিছুটা উপমহাদেশের সব ধর্মের বাদামি মানুষের বিরুদ্ধে।

ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে ‘নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে খ্রিষ্টীয় জঙ্গিদের যে উত্থান ঘটেছে, তা মানবসভ্যতাকে হুমকিতে ফেলবে এবং বিশ্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস নয়, এক ব্যক্তির পরিচালিত নেকড়ে আক্রমণ। এই জাতীয় জঙ্গিপনার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লোন উলফ’। এই সব মুসলিমবিদ্বেষী নেকড়ে দেশে দেশে আজ তাদের চক্রান্তের জাল বুনছে। তারা এখন একজন ভয়ংকর বড় নেতাও পেয়ে গেছে, তাঁর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউজিল্যান্ডের হামলাকারী শুধু যে গত এক দশকের অন্যান্য খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে তা–ই নয়, তার আদর্শিক গুরু ট্রাম্প।

এই যে বিশ্বব্যাপী মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড চলছে, এতে বাংলাদেশের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকেরা আজ ইউরোপ–আমেরিকার প্রায় সব দেশেই অবস্থান করছেন। তাঁরা শ্রম দিয়ে সেই সব দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাঁদের সেসব দেশে কেউ বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে না। অন্যদিকে তাঁরা তাঁদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখছেন। তাঁদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের উদ্বেগের আরেকটি কারণ, এখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদী মানুষের সংখ্যা নগণ্য নয়। হয়তো তারা এখনো সন্ত্রাসে হাত পাকায়নি। কিন্তু বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ওপর হামলা হতে থাকলে তারাও প্রতিহিংসা থেকে বিপজ্জনক পথে পা বাড়াতে পারে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস বিবেচনার বিষয়। সমাজে মানুষ তার মনের কথা স্পষ্ট করে প্রকাশ্যে নির্ভয়ে বলার পরিবেশ পেলে গোপন ষড়যন্ত্র করার পথ অনেকটাই বন্ধ হয়। আমাদের দেশে সেই পরিবেশ যদি নষ্ট হয়, তাহলে অন্য দেশের কুদৃষ্টান্ত থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে বিপথগামী হতে পারে।

হিংসায় আক্রান্ত পৃথিবী। তার শিকার সাধারণ মানুষ। এই অশান্ত ও উন্মত্ত পৃথিবীতে শান্তির বারি বর্ষণ করে প্রেমময় সমাজ প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। যে ধর্মাবলম্বী যে বর্ণের মানুষই হিংসার পথ বেছে নিক না কেন, তা ঘৃণাই। বহুদিন আগেই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কেন এ হিংসা-দ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ, কেন এ মান-অভিমান’। প্রগতিশীল পশ্চিমকে তার ছদ্মবেশ খুলে ফেলতে হবে। নির্ভেজাল মানবতাবাদই হিংসামুক্ত সমাজ ও পৃথিবী নির্মাণ করতে পারে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক