কংগ্রেস কি বিজেপিকে হারাতে পারবে?

নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধী। ফাইল ছবি
নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধী। ফাইল ছবি

রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বয়স এখন ১৩৪। স্বাধীনতার পর গত ৭২ বছরে এই দল ক্ষমতাসীন ছিল ৪৯ বছর। অন্তত ১০ বার তারা কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। কিন্তু দলটির বর্তমান নেতা রাহুল গান্ধীর অধীনে এখনো সেটা ঘটেনি। সর্বশেষ গান্ধী এখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। আসন্ন ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে কি সেটা সম্ভব হবে?

এ প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর দেওয়া কঠিন। আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষ্যকারই কংগ্রেস কর্তৃক মোদিকে হারানোর ব্যাপারে সন্দিহান। পাকিস্তানবিরোধী যুদ্ধ-উন্মাদনা মোদিকে শক্ত এক ভারতীয় নেতৃত্বের প্রতীকে পরিণত হতে সহায়তা করছে। জনমত জরিপগুলোর কোনোটিতে ‘সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে মোদিকে হারিয়ে সামনে আসেনি রাহুলের নাম।

তবে নির্বাচন শুরুর এখনো তিন সপ্তাহ বাকি। প্রতিদিনই দৃশ্যপটে নানান পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। এও জরিপে পাওয়া তথ্যই যে দরিদ্র ভোটাররা কম সময়ই অন্তরের কথা মতামত সংগ্রহকারীকে বলে থাকেন। জরিপ প্রতিবেদন অনেক সময় ভুলও প্রমাণিত হয়।

কংগ্রেসের আসন বাড়বে হয়তো, কিন্তু বিজেপির ভোটব্যাংক ধসেনি
ভারতে ২৯টি প্রদেশ। ২০১৪ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪৪টি পায়। অর্থাৎ রাজ্যপ্রতি গড়ে দুটি আসনও পায়নি তারা। দলটির নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল এটা। আবার গত নির্বাচনে লজ্জাজনক ফলের মধ্যে এও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, দলটি অন্তত ২৬৮টি আসনে প্রথম বা দ্বিতীয় ছিল। অর্থাৎ ভারতের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ নির্বাচনী আসনে কংগ্রেস এখনো প্রধান এক প্রতিদ্বন্দ্বী। এখনো সর্বভারতীয় দল বলতে তারা এবং বিজেপি। ২৯ প্রদেশের ভারতে অন্তত ১০টি রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে কংগ্রেস। এগুলো হলো আসাম, ছত্তিশগড়, গুজরাট, হরিয়ানা, কর্ণাটক, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও পাঞ্জাব। এই ১০ প্রদেশে রয়েছে লোকসভার ২২৪ আসন। এগুলোর মধ্যে গতবার কংগ্রেস মাত্র ২৯টি পায় এবং ১৫৪টিতে দ্বিতীয় হয়।

এই ১০ রাজ্যে এবার কংগ্রেস আসন বাড়াতে চায়। সেটা হয়তো বাড়বেও। কিন্তু প্রশ্ন হলো কত বাড়বে? বিজেপির সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার মতো বাড়বে কি? বিজেপি ও তার জোট গত জাতীয় নির্বাচনে ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার এই ভোট আরও বাড়বে—এমনটি মনে করা হচ্ছে না। কিন্তু এমনও প্রবণতা নেই যে বিজেপির ভোটব্যাংকে ধস নেমেছে। অনিশ্চয়তাময় একটা অবস্থা থাকছেই।

অন্যদিকে, কংগ্রেসের জন্য খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্র প্রদেশ ও বিহারের মতো অন্তত নয়টি রাজ্যে, যেখানে লোকসভার ২৯১টি আসন রয়েছে। সেখানে গত নির্বাচনে তারা মাত্র ১০টি আসন পায় এবং বাকি ৪৮টিতে দ্বিতীয় হয়। এসব রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো শক্তিশালী। তারা প্রভাব হারাচ্ছে—এমন লক্ষণ নেই আপাতত।

কংগ্রেস-বিজেপির ভরসা আঞ্চলিক মিত্ররা, কিন্তু পুঁজিপতিরা তাদের চায় না
যদিও বিজেপি ও কংগ্রেস জাতীয় দল হওয়ার গৌরব করে, কিন্তু বহু রাজ্যে কংগ্রেসের মতোই বিজেপিরও বড় ভরসা আঞ্চলিক মিত্ররা। বিজেপি অন্তত ৩০টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে মৈত্রী গড়েছে। উদারভাবে আসন ছেড়ে এসব দলকে সঙ্গে পেতে চাইছে তারা। ফলে কংগ্রেসকেও ছাড় দিতে হচ্ছে। এতে আঞ্চলিক দলগুলোর সম্ভাবনা বাড়ছেই। বহু সংগঠককে মনোনয়ন দিতে পারছে তারা। এ রকম স্থানীয় দলগুলো যদি গতবারের চেয়ে ভালো করে, তাহলে কংগ্রেস তো বটেই, বিজেপিরও ভোগান্তির শেষ থাকবে না। এ ক্ষেত্রে সবার নজর উত্তর প্রদেশের দিকে। এই রাজ্যে আসন রয়েছে ৮০টি। স্থানীয় দুই নেতা অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর জোট অবশ্যই এখানে কংগ্রেসের মতো বিজেপির জন্যও সমস্যা তৈরি করছে। এই জোট বিজেপির আসন কেড়ে নিলে কংগ্রেস খুশি হবে, কিন্তু বিজেপি বড় আকারে হেরে গেলে মায়াবতী রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দেবেন—এমন নিশ্চয়তা নেই। বরং আঞ্চলিক দলগুলো তখন ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ গড়তে চাইবে। ভারতের পুঁজিবাজারের ভারি অপছন্দ ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’কে। মোদির বিকল্প হিসেবে ভারতীয় পুঁজিপতিরা রাহুলের অতিরিক্ত আর কাউকে ভাবতে অনিচ্ছুক। যদিও এবার সে রকম একটা শঙ্কা থাকছেই।

গত আট লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কংগ্রেস ও বিজেপি যখনই আসন ৩০০–এর কম পেয়েছে, তখনই ভারতের কেন্দ্রে সরকার গঠনে বিতর্ক, বিবাদ, অস্থিরতা বেড়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির একটি গভীর প্রত্যাশার দিক হলো বিজেপি ও কংগ্রেস যেন যৌথভাবে ৩৫০ থেকে ৪০০ আসন পায়। কারণ, কেন্দ্রে অনেক দলের নাজুক ধাঁচের জোট ক্ষমতায় থাকলে বাণিজ্যিক স্বার্থ গ্রুপগুলো সহজে মন্ত্রিসভাকে দিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়াতে পারে না। বর্ণে বর্ণে বিভক্ত সমাজে আঞ্চলিক দলগুলোর স্বার্থে থাকে নানা বিরোধী ও ভিন্নতা। এবার বিজেপি যদি ৫০-এর বেশি আসন কম পায় এবং ওই আসন যদি আঞ্চলিক দলগুলোর হাতে যায়, তাহলে তৃতীয় শক্তির সরকার গঠনের একটা চেষ্টা থাকবে।

সুতরাং কংগ্রেসকে লড়তে হচ্ছে দুই প্রতিপক্ষের সঙ্গে। বিজেপির দিক থেকে তার রয়েছে অস্তিত্বহীন হওয়ার ভয়। এ ক্ষেত্রে লড়াইও প্রকাশ্য। কিন্তু অপর প্রতিপক্ষ আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে রাহুলকে মিত্রের অভিনয় করতে হচ্ছে। এসব দল কংগ্রেসকে দেখে আগ্রাসী মোদি-অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে সহনীয় কাঠামো হিসেবে। কিন্তু কংগ্রেসের জন্য এরূপ তৃতীয় ফ্রন্টও একধরনের পরোক্ষ হুমকি। এই হুমকির শঙ্কা অকার্যকর হতে পারে কংগ্রেস যদি মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি হিন্দিভাষী অঞ্চলে বিজেপির ব্যাপক আসন কমাতে পারে। গতবার এই অঞ্চলে বিজেপি শতকরা ৮৫ ভাগ আসন জেতে। এবার যদি তা ১০ ভাগও কমে, তাহলেও সেটা বিজেপির জন্য দুর্যোগ তৈরি করতে পারে। এসব অঞ্চলে বিজেপি-কংগ্রেস সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা ব্যতীত এমন রাজ্য প্রায় নেইই, যেখানে বিজেপি গতবারের চেয়ে বড় অঙ্কে আসন বাড়াতে সক্ষম। গত নির্বাচনে বিজেপি ২৮২টি আসন পেয়েছিল, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে মাত্র ১০টি বেশি। ফলে হিন্দিভাষী অঞ্চলে বিজেপির ফলই এবার দলটির এবং একই সঙ্গে কংগ্রেসের ভাগ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।

কংগ্রেসের সামনে অন্তত ১০০ আসন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ
বিজেপি ও কংগ্রেসের বাইরে ভারতের প্রায় সব দলই আঞ্চলিক চরিত্রের। এর মধ্যে কমিউনিস্টদের সর্বভারতীয় কিছু সাংগঠনিক কাঠামো থাকলেও কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বিহারের বাইরে তাদের নির্বাচনী শক্তি নেই। ছোট ছোট কমিউনিস্ট দল চাইছে মোদি হারুক। তবে প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে সব প্রদেশে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে লড়া সম্ভব নয়। কেরালা, বিহারসহ অনেক স্থানে কংগ্রেস তাদের প্রতিপক্ষ। বিহারে কমিউনিস্টরা পৃথকভাবে নির্বাচন করছে, যা কার্যত কংগ্রেসের বিপরীতে বিজেপির জন্য লাভজনক। আবার পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া না থাকলে তাতে লাভ হবে মমতার দলের। তবে নির্বাচন শেষে যদি দেখা যায় মোদির বিরুদ্ধে সরকার গঠন সম্ভব, তখন কমিউনিস্ট লোকসভা সদস্যরা রাহুলকে সমর্থন দেবেন। একই মনোভাব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, তামিলনাড়ুর ডিএমকে দল, অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টি এবং দিল্লির আম আদমি পার্টির। তবে ওডিশার বিজু জনতা দল এবং উত্তর প্রদেশ থেকে মায়াবতীর বহুজন পার্টি তা নাও করতে পারে।

এবারের ভারতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অনুমান-অযোগ্য অবস্থা বিরাজ করছে তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশে। এই দুই প্রদেশে ৬৪টি আসন এবং কংগ্রেসের এসব আসনের একাংশ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু, এই দুই প্রদেশে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে—এমন দলগুলো (তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং অন্ধ্রে টিডিপি) বিজয়ী হলে জাতীয়ভাবে কংগ্রেসের সম্ভাবনা বাড়বে।

সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে, কংগ্রেস যদি গত নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ৪৪-এর সঙ্গে আরও প্রায় ১০০টি আসন যুক্ত করতে না পারে, তাহলে তার ক্ষমতাসীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার একই সঙ্গে ১০০টি আসন পাওয়া কংগ্রেসের জন্য অতি আশাবাদী এক প্রত্যাশাও বটে।

বিজেপিবিরোধী শিবির যেভাবে মোদির সাজানো ছকে খেলছে
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বসাম্প্রতিক যুদ্ধ-উন্মাদনার আগের মাসগুলোয় খোলামেলাভাবেই মনে হচ্ছিল, দুর্নীতি, কৃষি খাতের সংকট ও বেকারত্বে মোদি সরকারের ইমেজ খারাপ হচ্ছে। কৃষক ও শ্রমিকদের বড় বড় লংমার্চ বিজেপির নির্বাচনী পতনের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে। বিগত ডিসেম্বরে হিন্দিভাষী তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি স্পষ্টভাবে আগাম সেই দুঃসংবাদ পায়। ওই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হলো এবং রাজনৈতিক আলাপের মূল বিষয় সরে গেল। পাকিস্তানে বোমা ফেলা ছাড়া ভারতবাসীর মনোজগতে এ মুহূর্তে আর কোনো বিষয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। রাহুল ও মমতার মতো মোদির চড়া গলার সমালোচকেরাও সর্বোচ্চ কেবল এইটুকুই প্রশ্ন তুলছেন, ভারতীয় যুদ্ধবিমান বোমাগুলো পাকিস্তানের ঠিক ঠিক স্থানে ফেলতে পারছে কি না। এমনকি যে ভারতীয় বৈমানিক আটক হয়ে ভারতের জন্য ব্যাপক কৌশলগত ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছেন, তাঁর প্রশংসার ক্ষেত্রেও মোদিকে হারাতে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজেপিবিরোধী শিবির। বিরোধী রাজনীতির এই মনোভঙ্গি মোদির জন্য লাভজনক হয়েছে। তিনি ‘ম্যাচ’টি ঠিক এভাবেই সাজাতে চাইছিলেন। এরূপ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে বেশ মানানসই। নতুন এই পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেসের সামনে ছয় মাস আগের নির্বাচনী সম্ভাবনাটি এখন প্রায় অধরা করে তুলেছে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক