বিপর্যস্ত ভৈরব ও টেকা

নদী দখলের বিষয়টি এখন রীতিমতো একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়’ পরিণত হয়েছে। দখলের বিষয়টি যে বেআইনি, সে কথা যেন সবাই ভুলতে বসেছে। দূষণ ও দখলকারীদের সামাজিকভাবে ছোট চোখে দেখা তো হয়-ই না, বরং যিনি যত বেশি জায়গা দখল করে টিকে থাকতে পারেন, সমাজে তাঁকেই তত বড় ক্ষমতাধর ও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মর্যাদা পেতে দেখা যায়। এই কূটাভাসকেই অতি সাধারণ বাস্তবতা হিসেবে আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি। মাঝখান থেকে দূষণ-দখলে একের পর এক নদ-নদী মরে যাচ্ছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, যশোর ও খুলনা জেলার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ভৈরব নদ দখল–দূষণের কবলে পড়ে মরতে বসেছে। সেখানকার টেকা নদীও দখলের শিকার হচ্ছে। ভৈরব এবং টেকার পাড় ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে বদলে গেছে এই নদ-নদীর রূপ। স্থানীয় ‘নদী রক্ষা কমিটি’ নামের একটি কমিটি আছে। কিন্তু সেই কমিটি দখল ঠেকাতে ভূমিকা রাখছে না। তারা বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।

সংবাদপত্রের ভাষ্য, ভৈরব নদের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করা হয়েছে অভয়নগরের ভাটপাড়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত। নদের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে অনেক গুদাম, দোকান ও আবাসিক স্থাপনা। নদ-সংলগ্ন কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাদের স্থাপনা সম্প্রসারণ করেছে। নদে অবস্থানরত বার্জ ও কার্গোতে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নদের মধ্যে বালু, ইট ও পাথর ফেলে পাকা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। দোকান ও কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে ভৈরব নদে। যশোর সদর ও মনিরামপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত টেকা নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আড়ত, দোকান, খাবার হোটেল।

ঢাকার দুই নদী বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বিআইডব্লিউটিএ যে ধারাবাহিক উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, তা দেশের অন্য এলাকার নদী দখল ঠেকানোর বিষয়ে উৎসাহ জোগাবে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের মতো যদি ভৈরব নদ এবং টেকা নদীর দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়, তাহলে খুলনা ও যশোর এলাকার সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। এই নদ-নদী স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। দুই তীর দখলমুক্ত করে এগুলোকে পুনঃখনন করা গেলে আবার এই নদ-নদী প্রাণ ফিরে পাবে।

এ ছাড়া নদী দূষণ রোধ করতে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যায়ের নিদারুণ উদাসীনতায় যেভাবে এই নদ–নদীর মরণাপন্ন অবস্থা হয়েছে, সেগুলোকে আগের অবস্থায় আনতে হলে একইভাবে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না—এই সহজ কথাটি ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সবাইকে বুঝতে হবে।