যে করে সে খায়, সে-ই বেশি দেয়

দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক। তঁাদের মাথায় একটাই চিন্তা, পাস করে কীভাবে একটা সম্মানজনক চাকরি পাবেন। তাঁরা পাস করেন, কিন্তু সবাই কাজ পান না। এমনিতেই চাকরির বাজার সীমিত। তার ওপর পাস করা ডিগ্রি থাকলেও চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং থাকে না। ট্রেনিং থাকলেও তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সনদ অনেকেরই থাকে না। ফলে তাঁদের বিদেশে চাকরি পাওয়া কঠিন। চাকরি জুটলেও বেতন কমে যায়। একই যোগ্যতা নিয়ে অন্য দেশের যুবকেরা বেশি বেতনে চাকরি করেন, কারণ তাঁদের ট্রেনিংয়ের আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন থাকে।

এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, এই যুবকদের চাকরির উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। এ সুযোগ তো সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থায় বেশ কিছু আছেই। আসল দরকার সেই ট্রেনিংয়ের আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা।

যুবসমাজের আরও অনেক সমস্যা আছে। সে জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দরকার। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়। সেই বাজেট যেন যুবকদের কাজে লাগে। যেমন, ইউনিয়ন পর্যায়ে যুবকদের জন্য এখনো কিছু বাজেট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু সেই বাজেট কিসের জন্য, যুবকদের কোন কাজের জন্য, সে সম্পর্কে অনেকে জানেনই না। তাহলে এমন বাজেটে যুবকদের কী কাজ হবে?

এ বিষয়গুলো ১৪ মার্চ প্রথম আলোর উদ্যোগে ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা হয়। প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান খুব সুন্দর ভাষায় বললেন, যে কাজ করে, তার জন্য উপযুক্ত আয় উপার্জন ও সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা করতে সরকার সব সময় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এবারও বাজেটে তার প্রতিফলন থাকবে। কারণ, যে কাজ করে, তার যদি খাওয়া-পরার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে কীভাবে কাজ করবে? কাজ করতে হলে তো খেতে হবে। এবং তার মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান হলে সে–ই দেশ ও সমাজকে সবচেয়ে বেশি দিতে পারে। তাই সরকার যুবদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিচ্ছে। কারণ, আজকের যুবসমাজই কালকের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।

মাঠপর্যায়ে সমস্যাগুলো বোঝার জন্য আমাদের আলোচনায় রংপুর ও বরিশাল থেকে দুজন তরুণ এসেছিলেন। তাঁদের দুজনই বললেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চান। যেমন গাছ লাগানো, শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেওয়া প্রভৃতি। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদে গেলে শোনেন বাজেট অল্প বা নেই। তাহলে কীভাবে চলবে। এখানে যথাযথ তদারকি দরকার। আমাদের তরুণেরা যদি কাজে সম্পৃক্ত না হতে পারেন, তাহলে তো যুবসমাজের শক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারব না। তরুণ অবস্থা থেকেই তাঁদের সমাজসচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। যুব বাজেটের একটা অংশ এদিকে ব্যয় করা দরকার। এবং দেখতে হবে কার্যকর প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে কি না।

অনেক সময় দেখা যায়, বরাদ্দ থাকলেও উপযুক্ত ও কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ না করায় বাজেটের টাকা ফেরত যায়। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? আমরা একদিকে বলি বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হোক, আর ওদিকে দেখা যায় বরাদ্দ বাজেট ব্যয়ের প্রকল্প নেই। এখানে পরিকল্পিত 
উদ্যোগ দরকার। কাজটা মোটেই কঠিন নয়। একটু মনোযোগই যথেষ্ট।

অক্সফামের মো. খালেদ হোসাইন বললেন, তরুণদের জন্য বরাদ্দ বাজেট সম্পর্কে তরুণসমাজের অনেকে জানেন না। যেমন, বরিশালে তরুণেরা গাছ লাগাতে উদ্যোগ নিয়ে জানতে পারলেন গাছের জন্য বাজেট আছে কিন্তু গাছ লাগানোর জন্য শ্রম বাজেট নেই। তখন তরুণেরা স্বেচ্ছাশ্রমে গাছ লাগান। এতে বোঝা যায়, বাজেট–প্রক্রিয়ায় তরুণদের সম্পৃক্ততা কম।

উইমেন চেম্বারের উলফাত জাহান মুন জানান, নার্সদের ভালো ট্রেনিং হয়। তাঁদের কাজের চাহিদাও অনেক বেশি। দেশে ও বিদেশে অনেক নার্স চাকরির সুযোগ পান। তাঁদের অনেকে ভালো চাকরিও করছেন। কিন্তু অনেককে আবার ফিরে আসতেও হয়। কারণ, তাঁদের যথাযথ ট্রেনিং নেই। অথচ ভারতের চেন্নাইয়ের নার্সরা উঁচু পদে চাকরি করছেন। কারণ, তাঁদের আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন আছে। আমাদেরও সে ব্যবস্থা করা দরকার।

সরকার এখন তিন ধরনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন। বিদেশে কাজ করার দক্ষতা অর্জন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিজ উদ্যোগে উপার্জনের মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন। এখন তরুণেরা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান শুরু করছেন। এ জন্য প্রাথমিক অর্থায়ন প্রয়োজন। এর ব্যবস্থাও সরকারের রয়েছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বললেন, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীন, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ইংরেজি, জাপানি, কোরীয়সহ পাঁচটি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

এসব উদ্যোগের নিশ্চয়ই একটা ফল আমরা পাব। ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান মো. ফারুক হোসেন এ বিষয়ে খুবই আশাবাদী। তিনি বললেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে এসব উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে।’ যুবসমাজ সেটাই চায়।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাংসদ আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি যুবসমাজের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বললেন। কিন্তু তারপর যেটা বললেন, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। তিনি বললেন, সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার সব বিষয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তুলে ধরবেন এবং কীভাবে যুবসমাজের উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়, সে চেষ্টা করবেন।

এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]