নির্বাচনে আস্থা ও ভোটারদের অনীহা

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং ভোট দেওয়া নিয়ে ভোটারদের উচ্ছ্বাস যথেষ্ট উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল এবং তা কার্যকর ছিল ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত। অন্তত পরিসংখ্যান তা–ই বলে। এই সময়ের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনটি বাদ দিলে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনগুলোতে গড়ে ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ। অপরদিকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বনিম্ন হার ছিল ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ওই সময়ে বিএনপিসহ কথিত ৪২ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো বড় দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। অথচ মাত্র চার মাস পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বেড়ে ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশে দাঁড়ায়। এযাবৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার সমাগম হয়েছিল, যার গড় ছিল ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় আট বছর পর অনেক নতুনত্ব নিয়ে; যার কারণে ভোটারদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ বেশি ছিল, বিশেষ করে শহর অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ভোটারদের মধ্যে।

২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুটি বৃহত্তর দলের ভোটার সংখ্যার গড় ছিল আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক ০৪ এবং বিএনপির ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যান্য দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি ৭ দশমিক ০৪ এবং জামায়াতের ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির মতোই ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি, যেখানে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে ভোটের গড়পড়তা হার ছিল ৪০ দশমিক ০৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, এই ভোটের হার শুধু বাদবাকি ১৪৭টি আসনের জন্য। এই গড় নিয়ে বহু প্রশ্ন তুলেছিল পত্রপত্রিকা ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম।

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না করা, বিরোধী দলের সহিংসতা এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহার সূচনা ঘটে। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও ভোট কারচুপির ব্যাপক ও দৃশ্যমান অভিযোগ এবং এসব অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা ভোটারদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা তৈরি করে।

এমন পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায় ভোটাররা উজ্জীবিত হয়েছিলেন একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশায়। কিন্তু তাঁদের হতাশ হতে হয়েছে। এই নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং এর জের থাকবে বহুদিন। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং একজন কমিশনার যে উক্তি করেছেন, তাতে কার্যত আগের রাতে বুথ দখল ও জাল ভোটের অভিযোগের কথাই স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা।

২০১৮ সালের নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যান নিয়েও জনমনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যানমতে, দেশব্যাপী গড়পড়তা ৮০ শতাংশের ওপরে ভোটার ভোট দিয়েছেন; অথচ পাঁচটি বড় শহর ও শহরতলিতে ছয়টি ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) গড়পড়তা ভোটের হার ছিল ৫১ শতাংশ। কাজেই এই পরিসংখ্যান নিয়েও বিস্তর মতভেদ রয়েছে। ইভিএমে প্রায় ৩০ শতাংশ কম ভোট কেন পড়ল, এর উত্তর পাওয়া যায়নি।

এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পেয়েছে ৭৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট এবং প্রধান বিরোধী এবং বড় দল বিএনপি পেয়েছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট। ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রায় ৭৪ শতাংশ ভোট। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এবারই প্রথম শত ভাগের ওপরে পরাজিত প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হতে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে অনিয়মের বিরুদ্ধে ৭৪টি মামলা হয়েছে। এটাও বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অভূতপূর্ব।

সংসদ নির্বাচনের পরপর অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ৩১ শতাংশ বলে নির্বাচন কমিশনের তরফে ঘোষণা করা হলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে যে হার তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অবাক হতে হয়। ঢাকা উত্তরের অনেক কেন্দ্রে, যেখানে শুধুই মেয়র নির্বাচন হয়েছে, ১০টির বেশি ভোট পড়েনি, এমনকি ৩ ভোট পড়ার খবরও পত্রপত্রিকায় বের হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরপরই উপজেলার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখ করার মতোই ছিল না। দেশের প্রায় সব পত্রিকা, এমনকি ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সরাসরি চিত্রেও এমনটাই দেখা গেছে। এই নির্বাচন একেবারেই একতরফা হয়েছে, বিশেষ করে চেয়ারম্যান পদে। এরপরও সংসদ নির্বাচনের মতো কিছু কিছু জায়গায় আগের রাতে ব্যালট স্টাফিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল; যা নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় ব্যাহত হয়েছিল। এই একতরফা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তুলনামূলকভাবে তৎপর দেখা গেছে। অথচ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। এভাবে ২০১৪ সালের পর থেকে জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ হারাতে থাকে।

২০১৪ সালের পর ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থাপনার যে ধস শুরু হয়েছিল, আশা করা গিয়েছিল ২০১৮ সালে সেই অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি; বরং পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা এসেছিল চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। বরিশালের নির্বাচন নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশন পরে হতাশা ব্যক্ত করেছিল। ভোটার সমাগম যে কম হচ্ছে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও স্বীকার করেছে, তবে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে নির্বাচন কমিশন যদি সক্ষম না হয়, তবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনমানুষের আস্থা ফেরানো কঠিন হয়ে যাবে।

যেকোনো নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার বহু কারণ থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ নিয়ে নানা মত আছে। সেখানে অনেক দেশে ভোট প্রদানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে ভোটার সমাগম কম হওয়ার কারণগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি এক নয়। আমাদের দেশে সাধারণ জনগণের কাছে ভোট উৎসব হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু ইদানীং সেই উৎসব যেন বিষাদে পরিণত হয়েছে। শুধু একটি বড় দলের অনুপস্থিতির কারণে ভোটারদের আগ্রহ কমেছে, তেমনটি নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অবশ্য তেমনটিই বলেছেন। এটি একটি বড় কারণ; কিন্তু মাত্র দুই মাস আগে যে ঢাকাবাসী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছিলেন এবং ৭৬ শতাংশ ক্ষমতাসীন দলের ভোট ছিল, সেখানে দুই মাসের মাথায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩০ শতাংশ ভোট পড়াটা কতখানি স্বাভাবিক? প্রশ্ন থাকে যে শুধু বিরোধী সমর্থকেরাই নন, সরকার-সমর্থক ভোটাররাও ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছেন।

আমাদের মতো দেশে নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের অনীহা বাড়ে যখন একজন ভোটার প্রতিবন্ধকতার কারণে ভোট প্রদান করতে পারেন না, ব্যাপক কারচুপির কারণে ভোটের ফলাফল উল্টিয়ে দেওয়া এবং প্রতিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের ভোটারদের নাজেহাল করার মতো ঘটনার কারণে। একই সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থাপকদের অকার্যকারিতা, আইন প্রয়োগের অক্ষমতা, সমান সুযোগ প্রদান করতে না পারা এবং সুস্থ পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়। একই বাস্তবতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ডাকসু নির্বাচনও আশাভঙ্গ ঘটিয়েছে। ২৮ বছর পর নির্বাচন হলেও মাত্র ৬০ শতাংশের কাছাকাছি ভোটার ভোট দিয়েছেন। এই নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা ছিল দৃশ্যমান।

আমাদের গণতন্ত্রের ভিত এমনিতেই সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, নির্বাচনের প্রতি মানুষ আস্থা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেললে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের ওপরে বড় আঘাত আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রধান স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এডাম বোনিকা ও মিখায়েল ম্যাকফল বলেন, যেখানে নির্বাচনে প্রচুর ভোটারের সমাগম হয় এবং ভোটারদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা থাকে, সেখানে গণতন্ত্র শক্ত ভিতের ওপর কার্যকর থাকে।

আমাদের দেশের নির্বাচনের ওপর ভোটারদের ক্রমবর্ধমান অনীহা এবং ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা হারানোর অবস্থার উন্নতি করা শুধু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বই নয়; এই দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]