পরিবেশ বাঁচাতে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের 'ফ্রাইডে'স ফর ফিউচার' আন্দোলন

বার্লিনে রাজপথে নতুন প্রজন্মের ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’ আন্দোলনকারীরা। ছবি: এএফপি
বার্লিনে রাজপথে নতুন প্রজন্মের ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’ আন্দোলনকারীরা। ছবি: এএফপি

ইউরোপে শুরু হয়েছে নতুন এক পরিবেশ আন্দোলন। এই নতুন আন্দোলনের কারিগর হলো স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের নতুন আদলের এই আন্দোলনের ঢেউ এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রথম দিকে সুইডেন, তারপর ইউরোপে কিছু দেশ, এখন এই পরিবেশ আন্দোলনের ব্যাপ্তি বিশ্বজুড়ে। ১৫ মার্চ শুক্রবার বিশ্বের ১১০ দেশের ১৭০০ শহরে এই আন্দোলনের সপক্ষে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে। তারা নেমেছে ওয়েলিংটন, সিডনি, টোকিও, কিয়েভ, এথেন্স, মাদ্রিদ, হংকং, রোম, প্যারিস, লন্ডন, বেঙ্গালুরু, বার্লিনসহ আরও অনেক শহরে। ১৫ মার্চ শুধু জার্মানিতেই ছোট-বড় ২১০ শহরে স্কুলের ৩ লাখ ছাত্রছাত্রী রাজপথে নেমেছে।

স্কুল ফেলে পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে নতুন এক আন্দোলন শুরু হয়েছে, নাম ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’। আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সুইডেনে, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের দেশে দেশে এবং বিশ্বজুড়ে। গত বছর গ্রীষ্মে সুইডেনের গ্রের্টা থুনবের্গ নামের এক ১৫ বছর বয়সী স্কুলছাত্রী এই আন্দোলনের সূত্রপাত করে। আন্দোলনের মূলনীতি হলো, স্কুলের থেকে পরিবেশ আগে। আর সেই নীতিবাক্য মেনে শুক্রবার শেষের দুটি পিরিয়ড ফেলে রেখে স্কুল ছেড়ে পরিবেশের জন্য রাজপথে।

গত ২৫ জানুয়ারি বার্লিনের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ছিল জার্মানির কয়লা কমিশনের বিশেষ সভা। বার্লিনের রাজপথে তখন হাজার হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী। তাদের হাতে ছিল পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে নানা প্ল্যাকার্ড। গন্তব্য ছিল তাদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ১১ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী এলিজা নিজের তৈরি প্ল্যাকার্ডে লিখেছে, ‘কেন আজকে স্কুলে যাব, যদি আগামীকাল আর পৃথিবীর অস্তিত্বই না থাকে?’ এলিজার সঙ্গে এসেছে দুই সহপাঠী। এই রকম অনেকে, যারা বয়সের কোঠায় ১০ থেকে কুড়ির মধ্য। বার্লিনের রাজপথে এমন হিমশীতল হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা উপেক্ষা করে নেমে এসেছিল প্রায় ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী।

এর আগে ১৮ ডিসেম্বর জার্মানির ২০টি শহরে প্রায় ২৫ হাজার ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’ আন্দোলনকারী রাজপথে নেমে এসেছিল। ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার বার্লিনে জার্মানির পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ছিল কয়লা কমিশনের একটি সিদ্ধান্তমূলক সভা। এর আগে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্তের পর জার্মানি কবে নাগাদ পরিবেশদূষণকারী কয়লা উৎপাদিত বিদ্যুৎ চুল্লিগুলো বন্ধ করতে পারে, সেই বিষয়ক সিদ্ধান্ত। জার্মানিতে কয়লা কমিশনে রয়েছেন পরিবেশবাদী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা।

দিনটিকে সামনে রেখে গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ২২ বছরের এক ছাত্রী, সুইডেনের গ্রের্টা থুনবের্গের শুরু করা ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’ আন্দোলনের জার্মান অনুসারীদের রাজধানী বার্লিনে সমবেত করেছিলেন। ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার বার্লিনের রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল, পরিবেশ বাঁচানোর সপক্ষে নতুন প্রজন্মের নতুন আদলের পরিবেশ আন্দোলনকারীদের পদচারণে। ক্রমেই এদের সংখ্যা বাড়ছে।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জোয়ান মিরো মিছিলে চিৎকার করে বলছে পরিবেশ নষ্টকারী কয়লার দ্বারা তৈরি জ্বালানি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মিছিলকারীরা বলছে, ‘আমরা এই আন্দোলন করছি আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য। ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই অবসর সময়ে নানা পোস্টার ফেস্টুন বানিয়ে সঙ্গে এনেছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় দীর্ঘক্ষণ ধরে ট্রেনে বা বাসে করে নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে তারা বার্লিনে এসেছিল।

‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’ জোটের প্রধান সংগঠক লুইসে নয়েবাওয়ার বলেছে, এটা অবিশ্বাস্য বিষয় যে কোনো দল বা সংগঠিত শক্তি না হয়ে শুধু পরিবেশকে বাঁচাতে পরিবেশকে ভালোবেসে জার্মানির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে ১০ হাজার নতুন প্রজন্মের পরিবেশপ্রেমী বার্লিনে একটি বিশেষ দিনে উপস্থিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষার জন্য আজ যাদের দায়িত্ব পালন করবার কথা, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না বলেই আমাদের মতো তরুণদের রাজপথে নামতে হয়েছে। কারণ, আমাদের বসবাসের জন্য আর কোনো দ্বিতীয় পৃথিবী নেই।’

সত্তরের দশক থেকেই জার্মানি তথা ইউরোপের পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের চাপ থেকে রক্ষা পেতে কয়লা ও আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি ব্যবহার থেকে ক্রমেই সরে আসছে ইউরোপ। কয়লা ও আণবিক চুল্লির ব্যবহার হ্রাস করে বিকল্প জ্বালানির বিকাশ ও ব্যবহারে এই মুহূর্তে জার্মানি এক অগ্রগণ্য দেশ। বিগত দুই দশক থেকে জার্মানিতে সৌর, বায়ু বা পানিবিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত জ্বালানির হার ক্রমেই বাড়ছে। জার্মানিতে একসময় কয়লা ও আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার হলেও পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে এই দুটি খাতনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থা থেকে তারা বের হয়ে আসছে। পরিবেশের স্বার্থে জার্মান সরকার এর আগে ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের হার ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলেছে৷ কিন্তু কিশোর-কিশোরীরা এতে সন্তুষ্ট নয়।

গত ২৫ জানুয়ারি বার্লিনে জার্মানির ২৮ সদস্যবিশিষ্ট কয়লা কমিশনের ২১ ঘণ্টাব্যাপী সভায় আগামী ২০৩৮ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কয়েক ধাপে কয়লা উৎপাদিত জ্বালানি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর আগে জার্মানিতে পরিবেশবাদীদের দীর্ঘদিনের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান সরকার ১৭টি আণবিক চুল্লি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ২০১১ সালে এথিক কমিশন গঠন করেছিল। আপাতসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালে জার্মানির সব আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর উভয় গোলার্ধের বেশ কিছু শিল্পোন্নত ধনী দেশের খামখেয়ালির কারণে বা অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে দক্ষিণ গোলার্ধের গরিব দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয় তথা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে। তবু উত্তরের এসব শিল্পোন্নত দেশের নাগরিক হয়েও ইউরোপীয় পরিবেশবাদীরা ইউরোপজুড়ে নানা ধরনের পরিবেশবিষয়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।এই ধরনের আন্দোলনের সর্বশেষ সংযোজন তরুণ প্রজন্মের ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার আন্দোলন, যা এখন পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]