নিরাপদ সড়ক চাই

ঘাতক বাসের নিচে চাপা পড়ে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সতীর্থদের আন্দোলন আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিল যে সড়ক মোটেই নিরাপদ নয়। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সড়ক পরিবহন নেতা ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রধান করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি গঠনের পরে তাদের এমন কোনো ‘নিয়ন্ত্রণ’ আমাদের চোখে পড়েনি, যা সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে পারে। এমনকি এই কমিটি মাত্র একবার বৈঠকে বসেছে এবং সেই বৈঠকও তারা মুলতবি করে দিব্যি এক মাস পার করে দিয়েছে। ওদিকে সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে।

এ কথা সত্য যে সড়কের সব ব্যাধি এক দিনে তৈরি হয়নি, রাতারাতি তা নিরাময়ও হবে না। কিন্তু গণপরিবহন খাতে যে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা চলে আসছে, সেটি দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ন্যূনতম উদ্যোগ না থাকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু এবং লাইসেন্স দিতে নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে যে কমিটি গঠিত হয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে খোদ জাতীয় সংসদেই প্রশ্ন উঠেছিল। যিনি কমিটির প্রধান, তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক সংগঠনই পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলার জন্য অনেকাংশে দায়ী। গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সড়ক পরিবহন খাতে কীভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়, সেটিও তারা সংশ্লিষ্টদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। সে সময় সরকারের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তায় মনে হয়েছিল, দ্রুতই তারা সড়ক নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু গত আট মাসে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বরং আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম যে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যে আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করেছেন। জনগণকে জিম্মি করে যঁারা এই ধর্মঘট পালন করেছেন, সরকার তঁাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামা কিশোর-তরুণদের নামে মামলা করেছে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি হত্যাকাণ্ডের শামিল। আবরার চৌধুরী আইন মান্যকারী নাগরিক বলেই জেব্রা ক্রসিং থেকে বাসে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। অথচ সেখানে আরেকটি বাস এসে তাঁকে চাপা দেয়। দেশের সড়কে নৈরাজ্য যে চলছে, তার প্রমাণ একই দিন সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় মা-ছেলেসহ সাত জেলায় আরও ১১ জনের মৃত্যু। গত ৭৫৩ দিনে এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৬৮। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরাও মনে করি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে বর্তমান সড়ক ব্যবস্থাপনা কাঠামোর খোলনলচে বদলে দিতে হবে। কোথায় কী সমস্যা, কোথায় কী পরিবর্তন আনতে হবে, তা মোটামুটি চিহ্নিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বঁাধবে কে?

সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা চালকদের দ্বারা হতাহতের ঘটনায় জাতীয় জীবনে বহুমাত্রিক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এটি একটি মানবসৃষ্ট জাতীয় দুর্যোগ। অতএব, ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আবরারের ঘটনায় উচ্চ আদালত তাঁর পরিবারকে সাত দিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সুপ্রভাত পরিবহন কোম্পানির প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।

সড়কে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনা রোধে যে আট দফা দাবি দিয়েছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে সড়ক নিয়ন্ত্রণ কমিটি পুনর্গঠন করে বিশৃঙ্খলা রোধে টেকসই পদক্ষেপ নেওয়াই সময়ের দাবি বলে মনে করি।