একটি রক্তাক্ত আইডি কার্ড ও এক ঘুমন্ত জাতি

সুন্দর একটি দিনের প্রত্যাশাতেই হয়তো বাসা থেকে বেরিয়েছিল আবরার। গন্তব্য বিইউপি—বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। তার ক্লাস আছে ঠিক সাড়ে আটটায়। জানি না, আবরার বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় তার মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছিলেন কি না কিংবা চুমু খেয়েছিলেন কি না ছেলের কপালে। আবরার কি বাসায় নাশতা করে বেরিয়েছিল? আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত সকালে কিছু খেতেই চায় না। কে জানে, সে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে বসে ইউনিভার্সিটির ক্যানটিনে বসে নাশতা করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আবরারের আর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে প্রগতি সরণিতে দ্রুতগামী এক বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। বাসের চাকায় পিষ্ট আবরারের মৃতদেহ পড়ে থাকে রাস্তায়। তার রক্তাক্ত আইডি কার্ডটি এক মুহূর্তে ঘোষণা করে, অকালে মৃত্যু হয়েছে আরেকটি সম্ভাবনাময় প্রাণের। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে বাসটির চাকায় পিষ্ট হয়ে আবরার মারা যায়, সেই বাসের নাম ‘সুপ্রভাত’। এই ‘সুপ্রভাত’ আবরারকে নিয়ে গেছে চিরনিশীথের দেশে, যেখান থেকে আবরার আর কখনো ক্যাম্পাসে ফিরে এসে তার বন্ধুদের হাসিমুখে বলবে না, ‘সুপ্রভাত’। সে কখনো আর ক্যাম্পাস থেকে ফিরে গিয়ে তার মায়ের কাছে পছন্দের খাবারের বায়না করবে না, অংশ নেবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায়, নিরাপদ সড়কের দাবিতে সে আর কখনো রাস্তায় নামবে না। আবরার জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারা যে আন্দোলনটি করেছিল, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

শুনেছি, সুপ্রভাতের বাসগুলো আবার নেমে পড়েছে নগরের রাস্তায় সব নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে। রাতারাতি তাদের মোড়ক বদলানো হচ্ছে। ‘সম্রাট’ নাম নিয়ে ‘সুপ্রভাত’ হয়তো আরও দানবীয় শক্তিতে দাপিয়ে বেড়াবে। এই সুপ্রভাতের মতো বাসগুলো প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দানবের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের। কখনো বৈশাখী, কখনো জাবালে নূর, কখনো বিসমিল্লাহ, কখনো আলিফ কখনোবা মায়ের দোয়া—নানা নামে এই বাস সার্ভিস শহরময় দাপিয়ে বেড়ায়। এই দানবদের মধ্যে চলে রেষারেষি। কাকে পিছে ফেলে কে এগিয়ে যাবে, সেই নেশায় বুঁদ হয়ে এরা ছুটতে থাকে। বাস তো যন্ত্র, চালকও সামান্য কর্মচারী। আসল দানব হলো পেছনে থাকা মুনাফায় অন্ধ মালিকপক্ষ।

তারাই লাইসেন্স ছাড়া চালক পেলে কম বেতনে গাড়িতে বসায়। এই মালিকেরা ফিটনেস সার্টিফিকেটকে তোয়াক্কা করে না, বৈধ কাগজপত্রের ধার ধারে না। তাদের আর মাফিয়া শ্রমিকনেতাদের জোরে ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহেও প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ট্রাফিক আইন অমান্য চলতে থাকে নির্দ্বিধায়। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোনো আশ্বাস কাজে আসে না এদের নিয়ন্ত্রণে, সমাধান হয় না সমস্যার। না বুঝে জায়গায়-অজায়গায় হেসে ফেলা মন্ত্রীরা মন্ত্রিত্ব হারান, কিন্তু রয়ে যায় তাঁর সাম্রাজ্য ও সৈন্যসামন্ত। তাদের প্রধান করে পুনরায় গঠন করা হয় ‘সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কমিটি’। এই প্রতাপশালী পিতাদের আশকারায় বখে যাওয়া দানবদের দাঁত বেরিয়ে আসে। তারা হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে আমাদের তাড়া করে, আমাদের সন্তানদের পিষে ফেলে। আর আমরা তা সয়ে যাই। বাসের ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে আকিফারা, বাসের চাকায় পিষ্ট হয়, মারা যায়। আর আকিফাদের হতভাগা বাবারা সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে নীরবে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরেন।

গত বছরের জুলাই মাসে বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর বাসের চাপায় প্রাণ হারিয়েছিল কলেজ শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব। এর পরের এক মাসের কাহিনি সবারই জানা। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। কিন্তু টনক নড়েনি। যে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, সে দেশে মানুষের জীবনের মূল্য আদৌ আছে কি? বাস্তবতা এই যে জীবন আজ বড় মূল্যহীন। আমাদের সন্তানদের কোনো নিরাপত্তা নেই এই দেশের সড়কে আর গণপরিবহনে। এটাই আমাদের নিয়তি। তাই আসুন, আমরা মেনে নিতে শিখি আমাদের নিয়তিকে। সড়ক পরিবহন আইনগুলো হিমাগারে নিশ্চিতে-নির্ভাবনায় শুধু আইন হয়েই ঘুমিয়ে থাকুক। আমরা প্রস্তুতি নিই সন্তানের মৃত্যুতে আরও নতুন নতুন ফুটওভার ব্রিজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার জন্য। ঢাকাকে পরিণত করি ‘ফুটওভার ব্রিজের নগরী’তে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের নাম অক্ষয় করে রাখি, আর আমরা পরিচিত হই কৃতী সন্তানের মা-বাবা হিসেবে। ফুটওভার ব্রিজের নিচে পড়ে থাকবে আমাদের সন্তানের দলিত-পিষ্ট লাশ, সঙ্গে রক্তাক্ত আইডি কার্ড আর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বই-খাতা। আর আমরা ফুটওভার ব্রিজের ওপরে উঠে ফিতা কাটব, ওয়াচ পার্টি করব আর হাসিমুখে সেলফি তুলব। কে জানে, কখন আমন্ত্রণ আসবে আপনার কিংবা আমার নতুন ফুটওভার ব্রিজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার! আসুন, প্রস্তুত থাকি।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]