কোথাও কি কোনো আশা আছে?

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হাতে প্ল্যাকার্ড।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হাতে প্ল্যাকার্ড।

ধরে নিন, ঘাপটি মেরে ঘরে বসে আছেন। কিন্তু আপনি কি নিরাপদ? খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ। কী বিষ খাচ্ছেন, নিজেই জানেন না। ঘরের মধ্যেই ঢুকে পড়ছে বিষাক্ত বাতাসের ছোবল। ঘরে থাকলে আগুনেও পুড়ে খাক হয়ে যেতে পারেন। রাস্তায় গাড়িচাপার শঙ্কা আছে। সৌভাগ্যক্রমে যদি গাড়িচাপার আগেই গাড়িতে উঠে যেতে পারেন, তবে সেখানে অপেক্ষা করছে আরেক বিপদ। ওত পেতে আছে মলম পার্টি। আপনাকে পাওয়া যাবে সড়কের পাশে অচেতন অবস্থায়। 

ভাগ্য সহায় হলে লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে। রাতে ঘরে ফিরছেন, ট্রাফিক জ্যামে পড়েছেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বসে আছেন। ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে মুঠোফোন, ল্যাপটপ। সমাজে পারস্পরিক বোঝাপড়ার চরম অবনতি ঘটেছে। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া–ফ্যাসাদ লেগেই আছে। খুন, জখম নিত্যদিনের ঘটনা। এমন নয় যে এগুলো আমাদের সমাজের নতুন উপাদান। কিন্তু সম্প্রতি মনে হয় অঘটনের হার বেড়েই গেছে। চরম এক অনিশ্চয়তা, ভয়, আতঙ্কের মধ্যে আছে সবাই। কখন কী হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। ঘরে–বাইরে কোথাও আপনি নিরাপদ নন। শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক; জনজীবনে কোনো ধরনের নিরাপত্তা নেই।

সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি চলছেই। পত্রিকার পাতা খুললেই দুর্ঘটনার সংবাদ। স্কুল, কলেজে সন্তানকে পাঠিয়ে আতঙ্কে থাকেন অভিভাবকেরা। স্ত্রী দুশ্চিন্তায় থাকেন স্বামীর জন্য। সন্তান পিতার জন্য। কার হাত খোয়া যাবে, কে পা হারাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেও কোনো লাভ হয়নি। রাজধানীতে ট্রাফিক সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যেই বেপরোয়া বাস কেড়ে নিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছল যুবক আবরারকে। আমাদের কর্তাব্যক্তিদের চোখে কি আবরারের ছবি পড়েছে? আবরারের জায়গায় কি নিজের সন্তানের চেহারাও ভেসে উঠেছিল? মনে হয় না। তা না হলে সারা দেশে বেপরোয়া চালকেরা নিয়ন্ত্রণে আসতেন।

সব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়ছে। এ নিয়ে কারও কোনো হেলদোল নেই। উপজেলা নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না। মাইকিং করেও ভোটারদের কেন্দ্রে আনা যায়নি। এরপরও পাহাড়ে ঝরে গেল তাজা প্রাণ। অঘটনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ২০১০ সালের নিমতলীর রাসায়নিকের গুদামের আগুনে ১২৮ জন পুড়ে কয়লা হয়েছিল। এরপর অনেক হাঁকডাক শুনেছি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সম্প্রতি রাসায়নিক কারখানা উচ্ছেদের হুমকিও দিয়েছিলেন। এসবই আসলে ফাঁকা বুলি। কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। তাই আবার চকবাজারে আগুন ফিরে এসেছে। এবার পুড়ে কয়লা হয়েছে ৭০ জন বা তারও বেশি। এসবে আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কিছু যায়–আসে না। আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন এত মৃত্যুর খবর পড়তে হয় যে এখন আর কোনো কিছু মনে হয় না। তাই আমাদের মধ্যে তাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজার শোক ফিরে ফিরে আসে।

এখানেই শেষ নয়। দুর্ঘটনারও শিকার হবেন। আবার তামাশারও শিকার হবেন। কেউ বলবে স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়ার কারণেই ভবন ধসে পড়েছে। কেউ বলবে পথচারী চেনার দরকার নেই। গরু–ছাগল চিনলেই চলবে। কেউ বলবে আপনি নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। অনেকেই বলবে চকবাজারে কি রাসায়নিকের ব্যবসা করার কথা বলেছিলাম? ওখানে ব্যবসা করতে গেলে কেন? সত্যি বলতে আপনি যে একটি দেশের নাগরিক, সেই দেশে আপনাকে দেখার কেউ নেই। এমনকি আমি, আপনিও আমাদের দেখছি না। মনে করছি, আমার তো কিছু হচ্ছে না। কিন্তু আমার যখন কিছু হচ্ছে, তখন আর কেউ থাকছে না আমার আশপাশে।

চকবাজারের ঘটনার আগেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লেগেছিল। এরপরই ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের অগ্নিনির্বাপনের সুবিধা নেই। এসব দেখার দায়িত্ব কার? এত এত ভবন কীভাবে নির্মিত হচ্ছে? আমরা তো এখন মধ্যম আয়ের দেশ। আমাদের সামর্থ্য নেই সেই কথা বলা যাবে না। তবে সব নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না কেন?

এর চরম অনিরাপত্তার কারণ দেশ শাসনে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। সুশাসন কই। নীতি–নৈতিকতার বালাই নেই। জনবান্ধব সরকার কই? কখনো ছিল কি? সরকার ও প্রশাসনের কোনো জবাবদিহি নেই। থাকলে এত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না। দক্ষিণ কোরিয়ায় কয়েক বছর আগে স্কুলশিক্ষার্থী বহনকারী ফেরি দুর্ঘটনায় সম্ভবত শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কোনো সভ্য দেশ হলে চকবাজারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কয়েক শ ব্যক্তির চাকরি চলে যেত বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মালিক আর জনগণ নয়। মনে রাখতে হবে, নাগরিকেরা রাষ্ট্রের সদস্য নন। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে একধরনের সম্পর্ক বিরাজ করে। সেই সম্পর্কের আওতায় রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সার্বভৌম না। জনগণের সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠন করে। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো ঘটনা। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। ওরা সব দখল করে নিয়েছে। তাই পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশে তো এখন ইয়াবা কারবারি ও সড়ক দুর্ঘটনার পক্ষের লোকজনকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় ইয়াবা নির্মূল বা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের। সবকিছু নিয়েই নিদারুণ ঠাট্টা, বিদ্রূপ চলে। আমজনতা নিরীহ সাক্ষীগোপালের ভূমিকায়। জনগণের রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব ফিরে না এলে এসব ঘটতেই থাকবে।

এরপরও প্রতিবাদ জারি আছে। তরুণেরা ফিরে ফিরে আসছে। তরুণদের নিপীড়নও করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদের পরও কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না; বরং সবকিছুই আগের মতোই থাকবে। আবাসিক এলাকায় পোশাকশিল্প থাকবে। ওষুধশিল্প থাকবে। রাসায়নিকের গুদামও থাকবে। খাদ্যে ভেজাল থাকবে। কারণ, এখানে রাজনীতি আছে। অর্থের হাতছানি আছে। অনেক কিছুরই হিসাব–নিকাশ আছে। শুধু ঢাকা কেন? গোটা দেশই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হোক না কেন শুধু রাজনীতিবিদদের হিসাব–নিকাশ ঠিক থাকলেই হবে। শেষাবধি জনসাধারণের জন্য কেউই নেই। কোথাও কেউ নেই। বাস্তবিক অর্থে গোটা দেশই মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঘরে থাকবেন, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে পুড়ে মরতে হবে। সড়কে যাবেন, গাড়িচাপা পড়বেন। কারখানায় কাজ করতে যাবেন, সেখানেও আগুন বা ভবনধসে চাপা খাবেন। ঢাকায় থাকেন না। গ্রামে থাকেন। সেখানেও রক্ষা নেই। খাবারের মাধ্যমে বিষ আপনার কাছেই ঠিকই পৌঁছে যাবে। আক্রান্ত হতে পারেন জীবনঘাতী রোগে। কোথাও যাবেন না। তেপান্তরের মাঠে নিরিবিলি বসে থাকবেন। তারও উপায় নেই। কারণ ঘরে আর না ফেরার শঙ্কা রয়েছে। হারিয়ে যেতে পারেন।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন