দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি খাতে সাফল্য

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়ন একটি গুরুতর বৈশ্বিক সমস্যা। এর ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন এলাকাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল অন্যতম। ওই অঞ্চলে উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদীতে জোয়ারের উচ্চতা ক্রমে বেড়ে চলেছে। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদীর জোয়ারের স্বাভাবিক উচ্চতা ছিল ২ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার। ২০০৪ সালের পর থেকে বাড়তে বাড়তে ৪ দশমিক ২২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঠেছে। ফলে জোয়ারের লবণাক্ত পানি উজানের দিকে অনেক দূর পর্যন্ত ফসলি জমি ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এটা কৃষিকাজের জন্য বিপর্যয়কর, কেননা লবণাক্ত পানি বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ার ফলে কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বরিশাল বিভাগের ৭ লাখ ৪১ হাজার ৩১০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১৮০ হেক্টর ইতিমধ্যে অতি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে বলে বরিশাল আঞ্চলিক মৃত্তিকা উন্নয়নের গবেষণা থেকে জানা গেছে। জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা সর্বোচ্চ ৮ ডেসিসিমেন পর্যন্ত হলে তা ধান ফলানোর উপযোগী থাকতে পারে, কিন্তু বরিশাল বিভাগের উল্লেখিত পরিমাণ কৃষিজমির লবণাক্ততা বেড়ে কখনো কখনো ১৬ থেকে ১৮ ডেসিসিমেন পর্যন্ত ওঠে। তাহলে ওই বিভাগের কৃষিকাজ কী প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, তা সহজেই বোধগম্য।

প্রতিকূলতার এখানেই শেষ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর–আইলার মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশে দাবদাহের মাত্রা বেড়ে গিয়ে মৌসুমি বৃষ্টি কমে আসবে, কিন্তু আকস্মিকভাবে অল্প সময়ে বিপুল বৃষ্টিপাত হতে পারে। আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের সংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।

এ রকম উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে একটা সুসংবাদ হলো সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত
হচ্ছে। বরিশাল বিভাগীয় কৃষি কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিন বছর ধরে ওই বিভাগের ছয়টি জেলায় ধানের ফলন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
২০১৫–১৬ অর্থবছরে শুধু আমন ধান উৎপাদিত হয়েছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৩ মেট্রিক টন। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন। তার পরের বছর আবহাওয়া বৈরী ছিল বলে আমনের উৎপাদন কিছু কম হয়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৮–১৯ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২১ লাখ ৪৪ হাজার ২২৬ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমন ধানের ফলন প্রায় ৫ লাখ টন বেশি হয়েছে। শুধু আমন নয়, আউশ ও বোরো ধানের আবাদও অনেক বেড়েছে। আগে দক্ষিণাঞ্চলের ওই জেলাগুলোতে আমন ধান ওঠার পর অনেক জমি ফাঁকা পড়ে থাকত। ঘূর্ণিঝড় সিডরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর কৃষকেরা সেসব জমিতে আউশ ধানের আবাদ শুরু করে অভূতপূর্ব সুফল পান। বোরো ধান ফলানোর প্রবণতাও বেড়েছে এবং বাড়ছে। একই সঙ্গে রবি ফসলের ফলনও বেড়ে চলেছে।

এই সাফল্যের পেছনে আছে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখে হাল ছেড়ে না দিয়ে অভিনব নানা পন্থায় টিকে থাকার অদম্য স্পৃহা ও পরিশ্রম। সেই সঙ্গে আছে বিজ্ঞানী–গবেষকদের সৃজনশীল প্রয়াস, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, ফসলের বৈচিত্র্য বাড়ানো, অব্যবহৃত জমির ব্যবহার, ইত্যাদি। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়বে—এ বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে এসব সৃজনশীল তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে।