লালমনিরহাটের সেই তিন এতিম কিশোরী এখন

এতিমখানার ভেতরের পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে লালমনিরহাটের তিন কিশোরী একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। তারপর হাসপাতাল ঘুরে এলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাড়ি। বলা হয়, ওই এতিমখানায় থাকার যোগ্য নয় তারা। এটা নিয়ে আমি একটা লেখা লিখি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে। তাতে অনেকের ধারণা হয় আমি বুঝি লালমনিরহাটের সরকারি এতিমখানার কথা বলেছি।

স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধান এবং শিশু অধিকার রক্ষায় তাঁদের প্রতিশ্রুতির তারিফ করতে হবে। তাঁদের দেওয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য আর দেশের নানা মানবাধিকার ও শিশু অধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের শোরগোলে তিন এতিম কিশোরীর ভাগ্যে ইতিবাচক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ইতিমধ্যেই বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে অন্য একটি তথ্য পরিষ্কার করা দরকার। যে তিন কিশোরীকে নিয়ে দেশব্যাপী দুশ্চিন্তা আর সহমর্মিতার আবহ তৈরি হয়েছে তারা লালমনিরহাটের সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) নিবাসী নয়। তারা থাকত আল নাহিয়ান শিশু পরিবারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে এটি পরিচালিত হয়। প্রথম আলোর প্রতিনিধির পাঠানো এবং গত মার্চ ৮ প্রকাশিত খবরে সেটা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে। তবুও মন্তব্য প্রতিবেদনে কথিত প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা ঠিক হয়নি। সেই জন্য যারপরনাই দুঃখিত।

পাঠকদের জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশে এই ট্রাস্টের সভাপতি সমাজকল্যাণমন্ত্রী, সহসভাপতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অপর নয় সদস্যের পাঁচজনই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা যেমন-মহাপরিচালক সমাজসেবা, অতিরিক্ত সচিব অর্থ মন্ত্রণালয় (ইকোনমিক রিলেশনস ডিভিশন—মধ্যপ্রাচ্য), অতিরিক্ত অথবা যুগ্ম সচিব গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, মহাপরিচালক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (পশ্চিম এশিয়া), যুগ্ম সচিব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ট্রাস্টের সদস্যসচিবও প্রেষণে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা। (রেফারেন্স No.MSWPro-2 Sec./Al-Nahyan-8/2003- 100 Dated: 19.08.2013 ) তার পরও এটি আমাদের সরাসরি রাজস্ব খাতের আওতাধীন না হওয়ায় এটি ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়।

মানবাধিকার কমিশন কী করবে ?
মানবাধিকার কমিশন লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসককে বিষয়টি তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছে। ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিলের মধ্যে মানবাধিকার কমিশন প্রতিবেদন চেয়েছে। জেলা প্রশাসক ঘটনার পরপরই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন বলে আগের সংবাদের আমরা জেনেছি। কাজেই এটা আশা করা যায়, যদিও আগামী বাংলা নববর্ষ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে, তবে তার আগেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ করে যেখানে শিশুস্বার্থ জড়িত, সেখানে আমাদের একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে যা একটা দিন বা একটা সপ্তাহ, অধিকারহারা একটা শিশুর কাছে তা জীবন-মরণের সময়কাল হয়ে যেতে পারে।

কিশোরীরা এখন কোথায়?
খবর ছিল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের আর এতিমখানা কর্তৃপক্ষ এতিমখানায় ফিরিয়ে নেবে না। তাই মানবাধিকারকর্মী আর সংবাদকর্মীরা জানার চেষ্টা করেছিলেন মেয়েরা তাহলে কোথায় আছে। কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছিল, তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। কোথায় বাড়ি? কার বাড়ি? কবে আসবে—আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে এসবের কোনো জবাব পাননি সংবাদ বা শিশু অধিকারকর্মীরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনজনের একজনের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা সম্ভব হয়েছে। সে এতিমখানায় ফিরতে চায়। তবে ওখানে যেন কেউ তাদের মৃত্যুচেষ্টা নিয়ে কথা না বলে। সেখানে যদি অসহ্য আর নিষ্ঠুর মন্তব্য চলে, তাহলেই সেখানে থাকবে কীভাবে? এটা তারও প্রশ্ন। এদের তিনজনেরই মনো-সামাজিক সহায়তা প্রয়োজন। মনো-সামাজিক সহায়তা এতিমখানার সব শিশুর বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির শিশুদের খুবই প্রয়োজন। এটা যেখানেই শিশু থাকে, সেখানকার একটা সার্বক্ষণিক কাজ।

আগের মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। ঢাকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ ..., আপনার সুন্দর লেখার জন্য। আমি নিজেও একজন এতিম ছাত্র। নয় বছর এতিমখানায় ছিলাম। কী অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এতিমখানার স্টাফরা করেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আশা করি এতিমখানানিবাসীদের পক্ষে আপনার তথ্যবহুল লেখা অব্যাহত থাকবে।’

আমরা অপেক্ষায় আছি
এতিমখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হওয়া মানুষেরা আরও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুন। যদ্দুর গলা যায় চিৎকার করে বলুন সমস্যাটা কোথায়। আমরা অপেক্ষায় আছি ভালো সংবাদের। শিশু পরিবারে থাকুক আর প্রতিষ্ঠানে থাকুক, সে যেন শান্তিতে থাকে, নিরাপদে থাকে। তার কথা যেন শোনা হয়। শিশুরা বর্তমান জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুরা যদি বর্তমানে ভালো না থাকে তা হলে দেশ কখনোই ভালো হবে না।

লেখক: গবেষক।