২৫ মার্চ স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত বাঙালি কখনো ভুলতে পারে না। সারাটা দিন মানুষের কেটেছিল অনেক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায়। ৭ মার্চের ভাষণে দেশবাসী এককাট্টা হয়ে অনন্য এক অহিংস আন্দোলন সূচনা করেছিল, যে অহিংস আন্দোলনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল সশস্ত্র প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ। যেকোনো মুহূর্তে নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপ নিতে পারে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের, সেটা মানুষ বুঝে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু খোলা রেখেছিলেন আলোচনার সুযোগ এবং খুলে দিয়েছিলেন অন্যতর প্রতিরোধের পথ। সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের উপায় তিনি পাকিস্তানি শাসকদের সামনে রেখেছিলেন, সে উপায় পদদলিত করে সামরিক সমাধানের পন্থা যদি পাকিস্তানি শাসকেরা অবলম্বন করে, তবে স্বাধীনতার আর কোনো বিকল্প থাকবে না, সেটাও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আঘাত হেনেছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, সেই আঘাত যে আসন্ন সেটা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল, তবে তা এমন বর্বর ও হিংস্র রূপ নেবে, সেটা অনুমান করাও ছিল দুঃসাধ্য। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল বটে, তবে যুদ্ধের নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা তারা করেনি। তারা আঘাত হেনেছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে, আর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল যথেচ্ছ। এই বর্বরতা সব সীমা অতিক্রম করেছিল, রূপ নিয়েছিল ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার, যা এতই নিষ্ঠুর যে এর বর্ণনার ভাষা মানুষের সংগ্রহে কিংবা অভিধানে ছিল না। যারাই বাঙালি জাতিচেতনায় বিশ্বাসী, তারাই হয়েছিল আক্রমণের শিকার। যারা হিন্দু, তাদের নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই হন্তারকের লক্ষ্য হয়েছে। দরিদ্র বসতির মানুষ রাজপথে অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিল, বঙ্গবন্ধু তাদের মুক্তির স্বপ্নে উদ্বেলিত করেছিলেন, তাই তাদের বসতি আগুনে ছাই করা হয়েছিল, গুলিবিদ্ধ হয়েছিল পলায়নপর নারী-পুরুষ-শিশু।

তারপর থেকে ২৫ মার্চ রাত চিহ্নিত হয়েছে কালরাত হিসেবে, জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কৃষ্ণময় রাত, যে রাতে সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশ জেনোসাইড। জেনোসাইড শব্দবন্ধ এমনি চরম নৃশংসতা বোঝাতে প্রথম উদ্ভাবিত ও প্রয়োগ হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, সংজ্ঞা অনুসারে কোনো জাতি বা ধর্মগোষ্ঠী কিংবা বর্ণ বা নৃগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে যে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, সেটা বোঝাতে এই শব্দবন্ধ। নৃশংসতা যার স্থায়ী অনুষঙ্গ, কেননা গোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকার কারণে যতটা, তার চেয়ে বেশি গোষ্ঠীগত পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হন।

২৫ মার্চ আমরা স্মরণ করে আসছি সেই সূচনাকাল থেকে। এই দিনটি প্রতীক হয়ে উঠেছে ৯ মাসজুড়ে দেশব্যাপী পরিচালিত সব হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ও সমূহ বর্বরতার। এই চরম দুঃখের দিনের পিঠাপিঠি আমরা পাই ২৬ মার্চ, আমাদের স্বাধীনতা দিবস, এভাবে নির্যাতন ও মুক্তি হয়ে আছে পরম্পর-সংলগ্ন।

২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে চিহ্নিত হোক, এমন আকুতি জাতির অন্তরে অনেক দিন থেকেই বহমান ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে ২৫ মার্চের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলে। অনেকের মধ্যে এই আকুতিও ছিল যে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করুক, জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করুক। সেটা ঘটেনি। তবে যা পাওয়া গেছে, সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর তারিখটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর ফলে আমরা পেয়েছি ২৫ মার্চ এবং ৯ ডিসেম্বর উভয় দিবস উদ্‌যাপনের সুযোগ। ২৫ মার্চ বাংলাদেশের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক পটভূমিকার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা যায়। আর ৯ ডিসেম্বর দেশে দেশে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যা একত্রে গেঁথে দেওয়া যায়।

আর এটাও তো উল্লেখ করা যায়, পৃথিবীতে রয়েছে তেমন কতক দুর্ভাগা দেশ, যারা শিকার হয়েছিল গণহত্যার এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব গণহত্যা স্মরণ দিবস। রুয়ান্ডাবাসী ৭ এপ্রিল পালন করে তাদের গণহত্যা দিবস হিসেবে, আর্মেনিয়ানরা ২৪ এপ্রিল, কম্বোডিয়া ২০ মে বিশেষভাবে স্মরণ করে গণহত্যা দিবস হিসেবে এবং ইহুদিরা ২৭ জানুয়ারি। ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল বিধায় আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুসারে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই দিনকে বিশ্বব্যাপী গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে ধার্য করেছে।

উল্লেখ্য, পরদিন ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত হয়েছিল সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং সেই দিনটি দেশে দেশে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের প্রায় সত্তর বছর পর, বিশ্বসভা ৯ ডিসেম্বরকে স্বীকৃতি দিল গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে। যদি এমন হতো যে গণহত্যা বিলুপ্ত হতে চলছে, দেশে দেশে গণহত্যা সংঘটনের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে, তবে এই বিলম্বের যৌক্তিকতা অনুধাবন করা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবজাতি একবিংশ শতাব্দীতে পা দিলেও মানবতা তার নৃশংসতা ও বর্বরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সুদান, ইয়েমেন, কঙ্গো, সিরিয়াসহ নানা স্থানে জেনোসাইডের বর্বরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার পেছনে সমর্থন জোগাচ্ছে শক্তিধর তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলো।

আমাদের নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমার নিজ দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিক কারেন, কাচেন, শান এবং সর্বশেষ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যামূলক আক্রমণ পরিচালনা করে এবং ১০ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে চরম নির্যাতনের পর বাংলাদেশে বিতাড়িত করে। যে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার হয়েছিল, সে দেশ আজ গণহত্যার শিকার প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্মিলনে এই অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছে বাংলাদেশ।

ফলে ২৫ মার্চ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের অতীত, আরও স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়বদ্ধতা, গণহত্যার স্মৃতি যেন কখনো আমরা না ভুলি, কিছুই না ভুলি এবং গণহত্যাকারীদের নৃশংসতার জন্য দায়ীদের আন্তর্জাতিক অপরাধের

জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ঘটাই। সেটা যেমন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। সেই দায়বদ্ধতার অনেক কিছু রয়েছে বাকি। ২৫ মার্চ সেই ঘণ্টাধ্বনি অনুরণিত করে, যা ধ্বনিত হচ্ছে আমাদের জন্য, মানবতার জন্য।

মফিদুল হক : লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব