সাবধান, ধেয়ে আসছে নারীবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদ

নারীবিদ্বেষী এই যুবকেরা ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসীর চাইতে কম ভয়ংকর নয়। ছবি: প্রতীকী
নারীবিদ্বেষী এই যুবকেরা ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসীর চাইতে কম ভয়ংকর নয়। ছবি: প্রতীকী

২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার আইলা ভিস্তায় এলিয়ট রজার নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণ ৬ জনকে হত্যা এবং ১৪ জনকে আহত করে নিজেও আত্মহত্যা করেন। এলিয়ট ক্রাইস্টচার্চে মুসলিম হত্যাকারী ব্রেন্টন টারান্টের ম্যানিফেস্টোর চেয়েও বড়—১৩৭ পৃষ্ঠার একটি চরম নারীবিদ্বেষী মেনিফেস্টো অনলাইনে আপলোড করে রাখেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশের নজরে আসে যে ‘মাই ট্যুইস্টেড ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের তাঁর মেনিফেস্টোটি ইতিমধ্যেই বহুল পঠিত এবং হাজার হাজারবার ডাউনলোড হয়েছে। হত্যা ও আত্মহত্যার আগে আগে ইউটিউবে তিনি ‘Elliot Rodger's Retribution’ (এলিয়ট রজারের প্রতিশোধ) নামে শেষ ভিডিওটি আপলোড করেন (যা পরে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ সরিয়ে নেয়)। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘আগামীকাল হতে চলেছে পুরো মানবজাতির বিরুদ্ধে আমার প্রতিশোধের দিন।’ সে বলেছিল, ‘সোনালি চুলের প্রত্যেক নষ্টা বেশ্যাকেই হত্যা করব। তোমরা দেখবে আমিই সেরার সেরা; আমিই আলফা পুরুষ’ [I will slaughter every single spoiled stuck-up blonde slut... You will finally see I'm the superior one. The true alpha male.]

এলিয়টের হত্যাকাণ্ডের পরপরই INCEL শব্দটি অনলাইনে-অফলাইনে পরিচিতি পেয়ে যায়। দেখা গেল ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অসংখ্য সাইটে ইনসেল শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদীদের ব্যাপক সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। এলিয়টেরও আগে ১৯৯৩ সালে কানাডার কুইবেকে আলানা নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র ‘আলানা’স ইনভলান্টারি সেলিব্যাসি প্রজেক্ট’ নামে একটি ওয়েবসাইট খোলার পর এদের কর্মকাণ্ড প্রথম সমাজবিজ্ঞানীদের নজরে আসে।

‘ইনভলান্টারি সেলেবেসি’ মানে বাধ্যগত নারী যৌনসংসর্গ-বঞ্চনা। এই আন্দোলনের সমর্থকেরা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ। তাদের বিশ্বাস, নারীর যৌনসেবা পাওয়া শ্বেতাঙ্গ পুরুষের অধিকার। কিন্তু নারীরা কেন তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ল না, প্রেম করল না, বিছানায় গেল না—এই ক্ষোভ নিবারণের জন্য প্রতিশোধ নেওয়াকেও তারা তাদের অধিকার এবং ব্রত মনে করে। ‘ইনভলান্টারি সেলেবেটরা’ (ইনসেল সদস্যরা) আন্দোলনটিকে ‘ব্রাদারহুড’ বা ‘বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ তকমা দিয়ে অন্যদের তাদের দলভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে চলেছে। অধ্যাপক বারবারা পেরি কানাডার সেরা সন্ত্রাসবাদ গবেষকদের একজন। তিনি সিবিসিকে জানালেন, ইনসেলরা মনে করে নারীর শরীরের ওপর তাদের একচ্ছত্র দাবি আছে এবং সন্ত্রাস তাদের জন্মগত মালিকানাধীন অধিকারের মতো একটি ব্যাপার এবং এই বোধই তাদের উজ্জীবিত করে রাখে।

বিশ্বজুড়ে ‘ইনভলান্টারি সেলেবেসি’ বা ‘ইনসেল’ নামের এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই যেভাবে সন্ত্রাসবাদ হয়ে উঠেছে, সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ইসলামফোবিয়ার পরই মিসোজিনিস্ট টেররিজম (নারীবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদ) সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক এই দলের মাধ্যমে নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা ছড়ানো আন্দোলন শাখা-প্রশাখায় বাড়ছে। এদের ৬০ হাজার সদস্য এখনো অত্যন্ত সক্রিয়।

সম্প্রতি কানাডার সিবিসি ব্রডকাস্টিং-এর ‘ফিফথ স্টেইট’ একটি অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছে। এতে দেখানো হয়েছে কানাডার মতো শান্তিবাদী দেশে সংঘটিত ১২০টি মারাত্মক উগ্র ডানপন্থী সন্ত্রাসের ১১৩টিই ঘটেছে উগ্র ডান শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠনের দ্বারা। এর মধ্যে এক বড় অংশ তীব্র নারীবিদ্বেষীদের দ্বারা ঘটেছে। সেই তুলনায় ইসলামি উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত সন্ত্রাসের ঘটনা কম, মাত্র ৭টি।

গত বছর ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ডের স্টোনম্যান ডগলাস হাইস্কুলে নিকোলাস ক্রুজ নামের যে সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১৭ জন ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করে, সেও দেখা গেল ইনসেল সদস্য; ফেসবুকে লিখেছিল, ‘এলিয়ট রজার, তোমাকে ভুলব না।’ নভেম্বরে ফ্লোরিডাতেই এক স্টুডিওতে ঢুকে দুই নারীকে হত্যা করে আরেক ইনসেল। ২০১৫-এর অক্টোবরে ইনসেল সদস্য ক্রিস হার্পার মার্সার ওরেগনের এক কমিউনিটি সেন্টারে গুলি চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা ও বহুজনকে আহত করে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে উইলিয়াম আচিসন মিনেসোটার হাইস্কুলে দুই ছাত্রকে হত্যা করে আত্মহত্যা করে। তার ছদ্মনাম ছিল এলিয়ট রজার-দ্য সুপ্রিম জেন্টলম্যান। শেল্ডন বেন্টলি নামের আরেক ইনসেল সদস্য ২০১৬-এর জুলাইতে কানাডার এডমন্টনে একজন অচেতন মানুষকে খুন করে।

মাত্র দুই মাস আগে জানুয়ারির ১৯ তারিখে আমেরিকার কলোরাডোয় নারীদের একটি মার্চে বড়সড় একটি হামলার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। পুলিশ ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে জমায়েতের অদূরে প্রায় প্রস্তুত হামলাকারীকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। নইলে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের মতোই। হামলা চেষ্টাকারী ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটাতে গিয়েছিল। ভাগ্যিস পোস্টটি পুলিশের নজরেও পড়েছে এবং পুলিশ অনুমানও করতে পেরেছে যে নারীদের জমায়েতটিই দুর্বৃত্তের লক্ষ্যবস্তু ছিল।

গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের এপ্রিলে অ্যালেক মিনাসিয়ান নামে এক ইনসেল শ্বেতাঙ্গবাদী যুবক কানাডার টরন্টোর রাস্তায় যাতায়াতরত মানুষের ওপর একটি গাড়ি উঠিয়ে দেন। ১০ জন পথচারী মারা পড়েন এবং ১৬ জন মারাত্মক আহত হন।

যা হয়—মিনাসিয়ানের আক্রমণের পরও নিয়মমাফিক পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক মাধ্যমে ত্বরিত প্রশ্নের খই ফুটতে লাগল—হত্যাকারীর নাম কী? মুসলিম নিশ্চয়ই? কোন দেশের? যখন জানা গেল শ্বেতাঙ্গ, নতুন প্রশ্ন এল—কাদের সঙ্গে চলত? মুসলিম বন্ধু-সহকর্মী কারা? ধর্মান্তরিত হয়নি তো? সিরিয়া-আইএস যোগাযোগ আছে কি না, খতিয়ে দেখছে না কেন পুলিশ ইত্যাদি। মিডিয়ার তৈরি করা মুসলিমবিদ্বেষীরা-হিস্টিরিয়া ও মগজের জগদ্দল যে সমাজমানসে কতটা জেঁকে বসেছে, সে সময় টের পাওয়া গিয়েছিল। মিনাসিয়ানের সমর্থকবাদীরাও যে কতটা সুসংগঠিত, সেই একই সময়ে সেসব অজানা-অদেখা সত্যগুলোও জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছিল অবশ্য। তখনই জানা গেল ইনসেলরা ইতিমধ্যেই ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে সুসংগঠিত হয়ে রয়েছে।

সিবিসির রিপোর্টটিতে পুলিশের সাবেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী অন্টারিওর ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইক আর্ন্টফিল্ডের বক্তব্য ছিল, ‘ইনসেল শ্বেতাঙ্গদের সন্ত্রাস নজরে না আসার কারণ হামলার শুরুতেই এদের একক হামলাকারী (লৌন ওলফ), বিপথগামী (ডিরেইঞ্জড), বিকারগ্রস্ত ইত্যাদি বিশেষণের অধীনে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এরা মারাত্মক বিপজ্জনক। সংশয়ের কোনোই অবকাশ নেই যে তাদের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা আছে, হত্যাপ্রবণতাও আছে; তাই তারা নির্দ্বিধায় যেকোনো কিছু করতে পারে। তা ছাড়া তারা সুসংগঠিত।’

মিনাসিয়ানের হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সমর্থকদের বিজয়োল্লাস করা পোস্টগুলো ছিল রীতিমতো ভীতিকর। কেউ লিখল হত্যাটি মিনাসিয়ানের ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ (শ্বেতাঙ্গ-দায়)। তাঁকে হিরো এবং আদর্শ খেতাব দেওয়া প্রশস্তিমূলক পোস্টও ছিল বেশ কিছু। ভ্যান হামলার আগে আগে মিনাসিয়ান ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল, ‘ইনসেল বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে’ (দ্য ইন্সেল রেবেলিয়ন হ্যাজ বিগান)’। আক্রমণের আগে-পরে সামাজিক মাধ্যমে ইন্সেলদের নারী ঘৃণার ধরন-ধারণসহ প্রতিশোধের তীব্র তাড়না প্রকাশ করা আলাপ-আলোচনাগুলো ছিল খুবই আতঙ্ককর। নানা পদ্ধতির নারীপীড়নের ফ্যান্টাসি তো আছেই, ইনসেল সদস্যদের পোস্টগুলো ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড উৎসাহিত করে চলছে অনায়াসে। এগুলো ছাড়াও ফিফথ স্টেইট আরও অন্তত ৩০টি মারাত্মক ইনসেল-সন্ত্রাসের তথ্য তুলে ধরেছিল।

সাধারণ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়ে আছে যে শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্য কালো মানুষ, মুসলিম ও অভিবাসীরা। আমরা অনেকেই জানি না যে পরবর্তী শিকার হতে চলেছেন নারীরা। এই সন্ত্রাসবাদ আরও বেশি বিপজ্জনক, কারণ শুধু কালো, মুসলিম বা অভিবাসী নারীই নয়, শ্বেতাঙ্গিনীসহ নারীমাত্রই এই দলভুক্ত সন্ত্রাসীদের ঘৃণার বস্তু। শুধু নারীই নয়, পুরুষ-শিশুসহ যেকোনো মানুষই এই সন্ত্রাসবাদের শিকার হতে পারে।

লক্ষণীয়, অশ্বেতাঙ্গদের দেশগুলোতে ইনসেল সদস্যদের কর্মকাণ্ড বা প্রভাব কম। এই কারণে ধারণা করা যায়, শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদ শ্বেতাঙ্গদের দেশে নানা রকম বিকৃত পথ ধরে এগোবে। মুসলিম নারীরাও দ্রুত নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন। বিশ্বময় নারীরা এই বিপদের আলোচনায় নামুক; প্রতিরোধে নামুক। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের রূপ ধরে সাধারণ নারীরা এগিয়ে আসুক। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর মানবিক সংহতি নির্মাণে এবার নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। নারীদের এই আগুয়ান ধারা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হোক।

হেলাল মহিউদ্দীন: লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।