হুইসেল বাজিয়েছিলেন ছাত্রীরাই

২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন হলো। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছাপ এখানে পড়বে না, এমনটা কেউ ভাবেনি। তবে ভাবা হয়েছিল, যেহেতু ব্যবস্থাপনাটা মূলত শিক্ষকদের হাতে থাকবে, সেখানে একেবারে ঢালাও পক্ষপাত থাকবে না। তবে বিপরীত দিকটা লক্ষণীয় হতে থাকে ডাকসু ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর থেকে। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি ব্যতীত সব ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর দাবি উপেক্ষা করে হলের মধ্যে স্থাপন করা হয় ভোটকেন্দ্র। ভোট নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয় মোট ছয় ঘণ্টা। ১৮টি হলের ৪৩ হাজার আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী এ নির্বাচনের ভোটার।

ছাত্রী হলের সবগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারি ছাত্রসংগঠন নিতে পারেনি বলেই ধারণা করা হয়েছিল, ভোটের ফলাফলে বড় প্রভাব রাখবেন ছাত্রীরা। তাঁরা অংশত রেখেছেনও। ছাত্রীদের চারটি হলে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। আর সম্ভবত তাঁদের একতরফা ভোটে ডাকসুর ভিপি হয়েছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক।

শুরু থেকে জানা যায়, ছাত্রীদের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে আগের রাতে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মেরে কিছু ব্যালট পেপার বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। ছাত্রীরা জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁদের বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাড়া দিতে বাধ্য হয়। একটি ছাত্রী হলে ব্যালট পেপার রাখা কক্ষ বেশ কিছু ছাত্রী সারা রাত পাহারা দেন। মৈত্রী হলের নির্বাচন কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে অপসারণ করা হয় প্রভোস্টকে। তেমন কিছু কারচুপির অভিযোগ রয়েছে রোকেয়া হল সম্পর্কেও। সেখানে ঘণ্টা দেড়েক ভোট বন্ধ ছিল। ওই হলেই নির্যাতিত হন সদ্য নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক। সব হলে ব্যালট পেপারগুলো আগের রাতে পাঠানো হয়েছিল। সংগতভাবেই সেগুলো ছিল প্রভোস্টদের জিম্মায়। তাহলে সিল দেওয়ার গর্হিত কাজটিতে তাঁদের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? তেমনি পুরো নির্বাচনব্যবস্থার মধ্যেই ছাত্রীদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ নজর কেড়েছে দেশ ও বিদেশে। তাঁরাই হুইসেল বাজিয়েছেন অনিয়ম ও অনাচারের বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের কারও কারও আপত্তিকর দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধেও।

আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা সরাসরি রাজনৈতিক দলভিত্তিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছেন। আইন তাঁদের সে সুযোগ দিয়েছে। রাজনৈতিক মতামত শিক্ষকেরা আগেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দিতেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ, পরীক্ষার হল, শৃঙ্খলা বা নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমানভাবে পক্ষপাতহীন ছিলেন। তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আর এ পাল্টানো বেদনাদায়ক এবং জাতীয় জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব রাখবে। এ ধরনের ভূমিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন যাচ্ছেন, তা নিয়ে পর্যালোচনা করতে বড় ধরনের গবেষণা প্রয়োজন হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ প্রথম আলোয় এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘দলীয় বিবেচনাপ্রসূত হয়ে শিক্ষক ও প্রশাসনের এ আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বিস্ময়কর নয়। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি পর্যায়ে দলীয়করণের যে ধারা কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে এক দশক ধরে তৈরি হয়েছে, সেখানে শিক্ষকেরা কেবল দল নয়, দলের ছাত্রকর্মীদের হাতেই বাঁধা পড়ে আছেন।’ আর সে দায়বদ্ধতা বিভিন্ন পদ-পদবি প্রাপ্তিতে তাঁদের সহযোগিতা করছে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাই বলে এমনটা করবেন! অবশ্য সবাই এমনটা করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১০ জন শিক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ফল ঘোষণার আগেই বিবৃতিতে নির্বাচন স্থগিত ও নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাও নিজে বিব্রত বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, ভোটের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এসব ব্যালট পেপার কেলেঙ্কারিকে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। হতে পারে। তবে সে ষড়যন্ত্রের স্বাভাবিক অংশীদার ব্যালট পেপার রক্ষকদেরই হওয়ার কথা।

বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতে, গোটা ব্যবস্থাই ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। ছাত্র হলগুলোতে কিছু আবাসিক ছাত্র লাইনের সামনের দিকে স্থান নিয়ে অন্যায্যভাবে বিলম্বিত করেছেন ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া। অনাবাসিক ছাত্ররা ভোট দেওয়ার সুযোগ তেমন একটা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। আবাসিক ছাত্রদের যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সহযোগী হতে হয়, তেমন দায়বদ্ধতা থাকে না অনাবাসিকদের। তাই সেই ছাত্রসংগঠন এদের ভোটের ওপর আস্থাশীল ছিল না; বরং প্রতিকূলে যেতে পারে মনে করেই ভোটদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। দায়িত্বরত শিক্ষকেরাও এ ব্যবস্থার প্রতিকার দেননি।

ছাত্রী হলগুলোর ভোটের ধারা দেখে যৌক্তিকভাবে অনুমান করা হয়, এভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন না হলে ফলাফল ভিন্নরূপ হতে পারত। তবে একটি বিষয় লক্ষ করার মতো যে দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলটির প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-সমর্থিত ছাত্রদল এ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। হতে পারে ক্যাম্পাসে তারা দীর্ঘদিন কোনো তৎপরতা চালাতে পারে না, এটি একটি বড় কারণ। তবে একমাত্র কারণ নয়। অন্যদিকে, বামঘেঁষা ছাত্রসংগঠনগুলোর ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক উপস্থিতি রয়েছে। তাদের দলীয় প্রার্থীদেরও ভোটের ফলাফল আদৌ সন্তোষজনক নয়।

ছাত্রী হলগুলোর ফলাফলের চিত্রটি প্রধানত অরাজনৈতিক। ডাকসুর ভিপির ক্ষেত্রেও তা–ই। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা নিকট অতীতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর সাফল্য লাভ করতে গিয়ে তাঁদের অনেকে নির্যাতিত হয়েছেন। এতে ছাত্রছাত্রীদের তাঁদের প্রতি কিছুটা অতিরিক্ত সহানুভূতি থাকতে পারে। আর তাঁদের কর্মসূচিতে আবাসন ও ক্যানটিন-সুবিধা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাসহ ছাত্রছাত্রীদের নিত্যদিনকার সমস্যাগুলোর কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, প্রচলিত ধারার রাজনীতি ছাত্রসমাজকে তেমন আর টানতে পারছে না।

ডাকসু এই বার্তা দিল যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও ভোট নিরাপদ নয়। আবার এ বার্তাও দিল যে ভোটাররা সচেতন হলে সেটি নিরাপদ করা যায়। একদিকে আমরা দেখলাম কিছু সর্বোচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক ক্যাম্পাস দখলে রাখা ছাত্রসংগঠনটিকে বেআইনি সুবিধা দিচ্ছেন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার দিকে তাঁদের নজর নেই। অন্যদিকে, আমরা দেখলাম হুইসেল সঠিক সময় ও স্থানে বাজাতে পারলে বেশ কাজ হয়।

অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে হুইসেল ব্লোয়ার বলতে কোনো অনিয়ম হতে দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা জনগণকে জানানোর দায়িত্ব পালনকারীকে বোঝানো হয়। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রীরা সেই হুইসেল ব্লোয়ারের কাজ করে দেখালেন।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব