ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল

বিভিন্ন দেশে, এবং বাংলাদেশে শ্রমবাজারেও এখন ‘গিগ অর্থনীতির’ (gig economy) প্রসার ঘটেছে। সেই আলোকেই পাঠাও, উবার, সহজ, ওভাই 

প্রভৃতি রাইড শেয়ারিং যাতায়াতব্যবস্থা বিচার করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কথা প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে সেদিন বললেন ব্র্যাকের স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্টের সিনিয়র ডিরেক্টর আসিফ সালেহ।

গিগ ইকোনমি হচ্ছে একধরনের খণ্ডকালীন কাজের ব্যবস্থা। সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে স্বল্প সময়ের জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ কর্মী বিশেষ শর্তে নিয়োগ করে। তাঁদের কাজের ধরাবাঁধা সময় হয়তো থাকে না। কর্মী নির্দিষ্ট সময়ে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করে দেন। সকালে হয়তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লেকচার দিলেন, দুপুরে কিছুক্ষণ উবার অ্যাপে যুক্ত হয়ে কয়েক ঘণ্টা কাজ করলেন, সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করলেন। এটাই হলো গিগ ইকোনমি। কর্মীর প্রতিটি কাজই সমাজের সবাই সম্মানের চোখে দেখেন। কর্মী খুশি। আয় বেশি। তাঁর কাজের স্বাধীনতাও বেশি।

আসিফ সালেহ বললেন, ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের মানুষ তাদের প্রথম সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করছেন বেকারত্ব আর দ্বিতীয়টি যাতায়াত সমস্যা। পাঠাও, উবার প্রভৃতি রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা এই দুটি সমস্যার সমাধানে অবদান রাখছে। এখনই অন্তত এক লাখ তরুণের খণ্ডকালীন কাজ ও পর্যাপ্ত আয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে বড় শহরগুলোতে যাতায়াতের ঝুটঝামেলা কমছে। রাইড শেয়ারিংয়ে যাতায়াতের ব্যয়ও সাধ্যের মধ্যে।

১৯ মার্চ প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকটি ছিল রাইড শেয়ারিং নীতিমালা সবার কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কয়েকটি অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধনের বিষয়ে। সহযোগিতায় ছিল পাঠাও, উবার ও সহজ। সেখানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করছে। যেহেতু আগে কম্পিউটার অ্যাপের মাধ্যমে এ ধরনের পরিবহনব্যবস্থা আমাদের দেশে ছিল না, তাই নতুন করে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। যদি কোথাও সংশোধন দরকার হয়, আমরা আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করব।’

একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেদিন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডাকলাম। সাত কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে যেতে ভাড়া চাইলেন ২৫০ টাকা। বললাম, পাঠাও বা উবারে তো ২০০ টাকায় যাওয়া যায়। অটোরিকশাচালক বললেন, ঠিক আছে ২০০ টাকা। পরে তিনি নিজেই বলেন, ‘স্যার, ওভাই–এ যোগ দিমু। যাত্রীও খুশি, আমিও খুশি। লাভও বেশি। ভাড়া নিয়া ঝগড়াঝাঁটি আর ভালো লাগে না।’

সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে, পরিবহনে এই নবাগত রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা তারই সুফল। কিন্তু পাঠাও, উবার, সহজ, ওভাই, ওবোন প্রভৃতি ১৬টি কোম্পানি চলছে, যদিও এখনো ওরা সরকারের তালিকাভুক্তির সনদ পায়নি। ৫ মার্চ সংসদে প্রশ্নোত্তরে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন বিবেচনাধীন। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু শর্ত পূরণ করতে পারছে না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’–এর কিছু অনুচ্ছেদের সংশোধন দরকার। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এরশাদুল আলম বলেন, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের আরও বিকাশের স্বার্থেই কয়েকটি অনুচ্ছেদ সংশোধন করা দরকার।

সরকার বোঝে যে রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার গুরুত্ব রয়েছে। তাই সরকার চায় আপাতত এই ব্যবস্থা চলুক। অবশ্য দ্রুতই নীতিমালা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে সনদের ভিত্তিতে চলার ব্যবস্থা করা হবে। এটা সবাই চায়। বেশ কয়েকটি নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন একজন গাড়ির মালিক শুধু একটি গাড়ি রাইড শেয়ারিংয়ে দিতে পারবেন, একটির বেশি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালাতে পারবেন না, অন্তত এক বছর পার না হলে নতুন গাড়ি রাইড শেয়ারিংয়ে দেওয়া যাবে না, সার্ভার দেশেই রাখতে হবে ইত্যাদি। ভ্যাট-ট্যাক্সেরও সমস্যা আছে।

এই শর্তগুলোর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন বিআরটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং উইংয়ের পরিচালক মো. লোকমান হোসেন মোল্লা। তাঁদেরও যুক্তি আছে। আবার ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বললেন, নিরাপত্তার স্বার্থে রাইড শেয়ারিংয়ের সব তথ্য দেশেই রাখা দরকার। স্টার্ট-আপ বাংলাদেশের টিম লিডার নাঈম আশরাফী বললেন, কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটা সিকিউরিটি ও স্টোরেজের ব্যবস্থা আছে। দেশের সার্ভারে সব তথ্য সংরক্ষণ ও নিরাপদে রাখা সম্ভব।

কিন্তু এ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। কারণ, রাইড শেয়ারিংয়ের শত শত গাড়ি একসঙ্গে যখন চলছে, তখন প্রতি মুহূর্তে লাখ লাখ তথ্য আদান–প্রদানের প্রয়োজন। এটা কি আমাদের দেশের সার্ভারে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে? যদি থাকে, তাহলেও ওই ব্যবস্থায় উত্তরণে কিছু সময় লাগবে। এখনই এই শর্ত পূরণ কঠিন।

এই কথাগুলো পাঠাওয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াস, উবার বাংলাদেশের প্রধান (লিড) জুলকার কাজী ইসলাম ও সহজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির খুব যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেন। এখানে লক্ষণীয়, এঁদের সবাই তরুণ উদ্যোক্তা। তাঁদের চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন। মনে হয় উন্নত বাংলাদেশ তাঁদের হাতের মুঠোয়। এটাই তো তারুণ্যের ধর্ম।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান আলোচনার মূল কথাগুলো তুলে ধরে বলেন, রাইড শেয়ারিং খাতকে আরও শক্তিশালী করে তোলা দরকার। তাই কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য বিআরটিএ, রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো, যানবাহনের মালিক, যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রতিনিধিদের মধ্যে সংলাপ হতে পারে।

আমাদের দেশে পাঠাও, উবার, সহজ, ওভাই প্রভৃতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ই-পরিবহনে বিপ্লব ঘটাতে পারে। একে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া আমাদের কর্তব্য।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক