আনিসুল হকের পাঁচরঙা স্বপ্ন ও বাসযাত্রীর এক দিন

একটি দুর্ঘটনা। গড়ে ওঠে আন্দোলন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, পরামর্শ আর প্রতিশ্রুতি। তারপর ঢাকাবাসী আবার ফিরে চলে নিত্যদিনের নয়টা-পাঁচটার পাঁচালিতে। বাসস্টপেজগুলোয় দৌড়ে বাসে ওঠানামা করে যাত্রী, যত্রতত্র রাস্তা পার হয় পথচারী, পুলিশ সার্জেন্ট রাস্তায় দাঁড়িয়ে করতে থাকেন জরিমানা, ভাড়া নিয়ে চলে যাত্রী-কন্ডাক্টরের খিস্তি, অফিস টাইমে বাসে উঠতে চলতে থাকে যাত্রীদের অনুনয়, পেছনে আসা বাসকে পাশ কাটাতে পাগলা টান দেন চালক আর আবার একজন আবরার, একজন দিয়া, একজন আরিফের নামে হাহাকারের গল্প তৈরি হয়। চক্রাকারে চলতেই থাকে।

আসুন, বাকি সব ভুলে একজন চালকের সঙ্গে একটি বাসের যাত্রী হই। চালক মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে তাঁর নিজের সহকারীর ও কন্ডাক্টরের মজুরি, গাড়ির তেল, রাস্তার বাকি খরচের চিন্তা মাথায় নিয়ে শুরু করেন যাত্রা। পথে উঠেই তাঁর চিন্তা কখন বাস সিটিং হবে, কখন বাড়তি যাত্রী নিয়ে পোষাতে হবে। এ কারণে প্রায় সারা রাস্তাই তাঁকে কেবল রাস্তার দিকে না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের প্রতিও সমান মনোযোগী হতে হয়। আপনারা যাঁরা এসব বাসে যাত্রা করেছেন, তাঁরা প্রায় দেখবেন, চালক দূর থেকে দেখেই সহকারীকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, ‘ওই মহিলা দুইটারে উঠা’ অথবা ‘বেডিং লইয়া হেরা মনে হয় গুলিস্তান যাইব, জিগা’ ইত্যাদি।

এরপর যাত্রীর টেনশন শেষ করে যখন বাস নিয়ে এগোবেন, ঠিক তখনই হয়তো কোনো যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছে কন্ডাক্টরের খিস্তি। এক–দুই কথা হওয়ার পর সেই বচসায় যোগ দেন চালক। অন্য যাত্রীরা তেড়ে ওঠেন, ‘তোমার বাস চালানোর কাজ, তুমি বাস চালাও।’ এই কথার পর আরও রেগে চালক এবার বলেন, ‘না পোষাইলে নাইম্মা যান।’ ততক্ষণে তাঁর মেজাজ তিরিক্ষি। মনের সব গালি নিয়ে, মন গাড়ির ভেতর রেখে কেবল চোখ দুটো সামনে রেখে স্টিয়ারিং হাতে বয়ে নিয়ে চলেন অজস্র জীবন।

এখনো শেষ হয়নি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট থাকেন চালকদের আইনের ভেতর রাখতে। চালকের কাগজপত্র চেক করেন তাঁরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে হয় জরিমানা অথবা গচ্চা। তাই সব চালকের আরেকটি নয়ন থাকে সার্জেন্ট কোথায় তা নজর রাখতে। চালকের গাড়ি চালানোর একটা অংশ এ খাতেও ব্যয় হয়।

এবার আসি প্রতিযোগিতায়। একই রাস্তায় কয়েকটি কোম্পানির কাছাকাছি রুটের গাড়িগুলোর মধ্যে চলতে থাকে প্রতিযোগিতা। এমনকি একই নামের গাড়ির প্রতিযোগিতাও খুবই নৈমিত্তিক ঘটনা। যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চালককে তাই ভরসা করতে হয় সহকারীর ওপর: ‘ওই, পিছে দেখ গাড়ি আহে নাকি।’ কিছুক্ষণ পরপর এ প্রশ্ন শোনাটা স্বাভাবিক। আর নিজে বুঝতে পারলে যাত্রী-পথচারীর এবং নিজের জান হাতে নিয়ে পেছনের গাড়ির ওভারটেক রুখতে তখন মরিয়া চালক।

আরও আছে। রাস্তায় গাড়ি চালানো পরিশ্রমের কাজ। জ্যাম-ঘাম-ধুলা-রোদ-বৃষ্টি-ভাঙা রাস্তা-গর্ত-গাড়ি নষ্ট-লুকিং গ্লাস না থাকা—সব সামলেই চালক গাড়ি চালান। খরচের এই শহরে মালিকের জমা আর সব হিসাব বাদ দিয়ে তিনটি প্রাণীর আয়–রুজি ঠিক রাখতে ফজরের আজানের পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গাড়ি চালান—এমন চালক অসংখ্য। তাহলে ক্লান্তি ছাড়া তাঁদের পক্ষে স্টিয়ারিং ধরা কি সম্ভব? আর এই পরিশ্রম ছাড়া নিজের সংসারের চাকা সচল রাখা কি সম্ভব?

এবার আসুন ভিন্ন একটা গল্প শুনি। এই শহরে কিছু চালক আছেন, যাঁদের ওপরের বিষয়গুলোয় মনোনিবেশ করতে হয় না বললেই চলে। তাঁরা ঠান্ডা মাথায় স্টিয়ারিং আর রাস্তা খেয়াল রেখে গাড়ি চালাতে পারেন। ভাবছেন কীভাবে সম্ভব? সম্ভব, বিআরটিসি বাসে ভ্রমণ করেই দেখুন না। কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে যাত্রীরা গাড়িতে ওঠে। ফলে দৌড়ে, ঝুঁকি নিয়ে কোনো যাত্রীকে বাসে উঠতে হয় না। টিকিট যেহেতু আগেই কাটা হয়েছে, ভাড়া নিয়ে খিস্তির বালাই নেই। রাস্তার পাশে যাত্রী তুলে ওই দিনের আয়ের হিসাব ঠিক রাখার টেনশন নেই। রাস্তায় সার্জেন্টের চেক নিয়ে শঙ্কা সামান্য। পেছনের গাড়ির সঙ্গে পাল্লার বালাই নেই। এমনকি এসি বাস সার্ভিসগুলোতে চালক একাই গাড়ি চালান। সহকারীরও প্রয়োজন হয় না।

কাউন্টার সেবা ছাড়া যেসব বাস চলছে, সেগুলোর চালকেরা চালক নাকি পরিচালক? তাঁদের মাথা ঠান্ডা রেখে স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে পূর্ণ মনোযোগে গাড়ি চালানোর পরিস্থিতি আদৌ আছে কি?

তাহলে এই মৃত্যুমিছিল আর সাধারণ যাত্রীদের জন্য সুষ্ঠু গণপরিবহন–ব্যবস্থার সমাধান কোথায়? প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক অসংখ্য রুট বাতিল করে পাঁচ রঙের যে চার হাজার বাসের কথা বলেছিলেন, সেখানেই অনেক বড় সমাধান। এই একটি সিদ্ধান্তে লুকিয়ে আছে চলন্ত বাস থেকে নামতে বা উঠতে গিয়ে মৃত্যু রোধের সমাধান, চালককে মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করার সমাধান, পথচারী দেখে, আইন মেনে, যথাযথ কাগজপত্র নিয়ে গাড়ি চালানোর সমাধান, অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে সমমুনাফার সমাধান।

তাই পরেরবারের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-পরামর্শ-প্রতিশ্রুতির চক্রে প্রবেশের আগেই কীভাবে আনিসুল হকের পাঁচ রঙের স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করা যায়, চলুন সেটা নিয়ে ভাবি সবাই।

নওসিকা নোরা: ফ্রিল্যান্স লেখক
ই–মেইল: [email protected]