শিক্ষক এমপিওভুক্তি

এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষকেরা সময়ে সময়ে অনশনে যাবেন, অবস্থান ধর্মঘট করবেন, কিন্তু রাষ্ট্র কোনো প্রতিকার করবে না, এটি শিক্ষা কিংবা শিক্ষক—কারও জন্য ভালো খবর নয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা মনে করছেন, সমাধানের চাবিকাঠি প্রধানমন্ত্রীর হাতেই। সে কারণে তাঁরা ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের’ দাবি পূরণ করার শর্তে এক মাসের আলটিমেটাম দিয়ে আপাতত অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।

আমরা বুঝতে পারি, শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষকদের অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে। আর এ রকম অস্বস্তিকর অবস্থা যত বেশি দিন জিইয়ে রাখা হবে, তত বেশি শিক্ষকেরা হতাশায় ভুগবেন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থী তথা শিক্ষার ওপরও পড়বে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে হযবরল অবস্থা চলছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি, কিছু এমপিওভুক্ত, আর বাকিগুলো রেজিস্টার্ড ও নন–এমপিওভুক্ত; যদিও তারা সবাই অভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষা দিয়ে থাকে। অবকাঠামোগত সুবিধা, শিক্ষার্থী সংখ্যা ও পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি কিংবা এমপিওভুক্ত হওয়ার নীতিমালা থাকলেও সব ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। আর তুলনায় মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গেছে এমপিওভুক্তির বাইরে।

বর্তমানে সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ২৮ হাজার। এর প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতায় মাসে খরচ হয় ১ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে স্বীকৃতি পাওয়া নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। স্বীকৃতির বাইরেও কয়েক হাজার নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর থেকেই এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলন করে আসছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনসহ কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছিলেন তাঁরা। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রিসভায় তোপের মুখে পড়েছিলেন বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। এরপর সরকার এ বিষয়ে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে।

এমপিওভুক্তি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই গুরুতর যে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। গত নভেম্বরে খোদ শিক্ষা ভবনে এমপিও দুর্নীতির দায়ে তিনজন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমরা আশা করব, ঘোষিত নীতিমালার ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন তালিকা তৈরি করা হবে এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘চারটি নির্ণায়কের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।’ কোনোভাবেই যাতে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ না ওঠে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির সময় প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সাংসদদের পছন্দসই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি সংখ্যায় এমপিওভুক্তি পেয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এর অর্থ যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে জোরদার তদবির ছিল, তারাই এমপিওভুক্ত হয়েছে, নীতিমালার শর্ত পূরণ না করেই। এর পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়।

নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা বহু বছর ধরে আন্দোলনে আছেন। অনেকের চাকরির বয়সও শেষের দিকে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি অঙ্গীকার পূরণে নির্দিষ্ট করে যে ‘দু-এক মাস’ সময় নিয়েছেন, সেটি যেন আর না বাড়ে। এই আধপেট খাওয়া শিক্ষকদের ধৈর্যের পরীক্ষা আর যেন প্রলম্বিত না হয়। এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান দরকার।