আদভানিকে যেভাবে বিদায় করলেন মোদি

লৌহপুরুষকে দেখে কষ্ট হতেই পারে। ৯১ বছর বয়সে তাঁকে যবনিকার আড়ালে ঠেলে দেওয়া হলো।

সেই জনসংঘের দিন থেকে যে সংগঠনকে তিল তিল করে তিনি গড়ে তুলেছেন, এই মর্যাদাহীন অবসরের দিনে সেই সংগঠনের মৌনতাও নিশ্চয় তাঁকে ব্যথিত করেছে। জনসংঘকে পাশে রেখে দেশের স্বার্থে জনতা পার্টিতে যোগদান, পরবর্তী সময়ে দ্বৈত সদস্য পদের প্রশ্নে মতভেদকে কেন্দ্র করে বিচ্ছেদ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির পত্তন থেকে শুরু করে পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত লালকৃষ্ণ আদভানিই ছিলেন বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’। ‘বিকাশপুরুষ’-এর বিশেষণটা ছিল অটল বিহারি বাজপেয়ির জিম্মায়। বিজেপিতে তাঁরাই ছিলেন রাম-লক্ষ্মণ জুটি। অটল বিহারি অস্তাচলে যাওয়ার আগেই সেই জুটি ভেঙে গেছে। নবতিপর আদভানির ইনিংসও শেষ হলো। ছিনতাই হয়ে গেল তাঁর এত দিনকার খাসতালুক। গুজরাটের গান্ধীনগরের সাতবারের সাংসদের জায়গায় এবার অন্য নাম লেখা হবে। সপ্তদশ লোকসভায় ট্রেজারি বেঞ্চের প্রথম সারির আসনটিও নিশ্চিতই সবার অলক্ষ্যে দুফোঁটা অশ্রু ঝরাবে। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলে আসা এক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতারও অবসান ঘটছে। কালের নিয়মে যাওয়ার কথা সবারই। কিন্তু এভাবে যাওয়াটা আদভানির অন্তত পাওনা ছিল না।

কীভাবে সরে যেতে হলো তাঁকে? দোলপূর্ণিমার রাতে বিজেপি এবারের ভোটের প্রথম প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করল। গুজরাটের গান্ধীনগরের একটিমাত্র আসনের প্রার্থীর নাম ছিল সেখানে—দলীয় সভাপতি অমিত শাহর। নির্বাচন কমিটির সম্পাদক জগৎ প্রকাশ নাড্ডার স্বর একটুও কাঁপল না অমিত শাহর নাম ঘোষণা করার সময়। কেন আদভানি নন, সে বিষয়ে একটি শব্দও তিনি খরচ করলেন না। চরম নিষ্পৃহভাবে আদভানির নামটি অনুচ্চারিত রেখে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এত দিন তিনি ছিলেন, এবার থেকে আর থাকছেন না। রাজনীতি নিষ্ঠুর সবারই জানা। কিন্তু অনুশাসিত বলে গর্ব করা বিজেপির কাছে রাজনীতি যে এতখানি হৃদয়হীন, আদভানির অপসারণের মধ্য দিয়ে তা বোঝা গেল। অনুশাসনের বেড়া আদভানি কিন্তু টপকাননি। নিজে থেকে একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি। কিন্তু জানাজানি হয়ে গেছে, বর্তমান বিজেপির এক ও অদ্বিতীয় জুটি কীভাবে ‘আদভানি বধকাব্য’ রচনা করল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে যেতে পারতেন ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডে তাঁর একসময়কার রাজনৈতিক গুরুর বাড়ি। লোককল্যাণ রোডে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি নিবাস থেকে দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। গিয়ে বলতে পারতেন, এই বয়সে তাঁর আর ভোটে দাঁড়ানোর ঝক্কি নেওয়ার দরকার নেই। সেটাই হতো গুরুর প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত সুবিচার। মোদির স্মৃতিশক্তি দুর্দান্ত। জীবনেও তিনি ভুলবেন না মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকায় রুষ্ট বাজপেয়ি কোন ভাষায় ‘রাজধর্ম’ পালনের কথা বলেছিলেন। মোদিকে সরাতে কীভাবে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। সেই অবস্থা থেকে আদভানি কীভাবে মোদিকে বাঁচিয়েছিলেন, কতটা ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে আড়াল করেছিলেন, মোদির তা ভোলার কথা নয়। তা ছাড়া আদভানির হিন্দুত্ববাদী রথের যোগ্য উত্তরাধিকারও তো তাঁর ওপরেই বর্তেছে! অন্ধের মতো অনুসরণ করেছেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুর প্রতিটি পদক্ষেপ। তাঁর কাছে গিয়ে ভোটে না দাঁড়ানোর কথাটুকু আদায় করলে আজ এত সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হতো না। এই বিনয়টুকু আর যা-ই হোক, মোদির দুর্বলতা বলে মনে করত না কেউ। কিন্তু সেই রাস্তায় মোদি হাঁটলেন না। এই ভুল অনিচ্ছাকৃত নয়, বরং এই মনোভাবের মধ্য দিয়ে মোদি গোটা দলকে বুঝিয়ে দিলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি কতটা কঠিন, কতখানি নির্মম। নিজে না গিয়ে একান্ত অনুচর অমিত শাহকেও পাঠানো যেত আদভানির কাছে। অমিত শাহকেও পাঠালেন না মোদি। পাঠালেন সংঘের নেতা রামলালকে। আদভানিকে তিনি বললেন, দল চায় ভোটে না দাঁড়ানোর ইচ্ছার কথা তিনি নিজেই যেন দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে জানিয়ে দেন। অপমানিত আদভানি চুপ করে রামলালের কথা শুনেছিলেন। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

মোদি-শাহ জুটি এভাবে ভোটে না দাঁড়ানোর কথা কবুল করিয়ে নিয়েছে অন্যদের কাছ থেকেও। বিশেষত সেই নেতারা, যাঁরা এখনো বাজপেয়ি-আদভানির প্রতি অনুগত। বাজপেয়ি-আদভানির অনুগতদের এক এক করে এই পাঁচ বছরে মোদি-শাহ জুটি ছেঁটে ফেলেছে। যশবন্ত সিনহা, অরুণ শৌরীরা আগেই বাদ গেছেন। এবার গেলেন শান্তা কুমার, ভুবনচাঁদ খান্ডুরি, শত্রুঘ্ন সিনহারা। লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। উমা ভারতীও সরে গেছেন হাওয়া বুঝে। হাওয়া বোঝার সেই ক্ষমতা আছে সুষমা স্বরাজেরও। স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে বিদিশার এমপি অনেক দিন আগেই তাই জানিয়ে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে, আর ভোট নয়। বাকি ছিলেন মুরলী মনোহর যোশি। আদভানির মতো তাঁর কাছেও বার্তাবহ হয়ে গিয়েছিলেন রামলাল। ক্ষুব্ধ মুরলী মনোহর তাঁকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নিজে থেকে সরে দাঁড়াবেন না; বরং কানপুরে এবারও ভোটে দাঁড়াতে তিনি প্রস্তুত। পদার্থবিদ্যার এই অশীতিপর অধ্যাপকের রাজনৈতিক জীবনও আদভানির মতো নিবুনিবু।

দেয়ালের এই লিখন আদভানির পড়া উচিত ছিল পাঁচ বছর আগেই। বাজপেয়ির রোষ থেকে একদা যাঁকে রক্ষা করেছিলেন, সেই শিষ্যকে প্রধানমন্ত্রী খাড়া করে ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্তের তুমুল বিরোধিতা করে হার মানতে হয়েছিল তাঁকে। সে সময় যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সুষমা ছাড়া একজনও মোদির কাছে কল্কে পাননি। আর আদভানি? পাঁচ বছরে লোকসভায় ৯২ শতাংশ হাজিরা তাঁর, অথচ শব্দ উচ্চারণ করেছেন মাত্র ৩৬৫টি! আগের পাঁচ বছরে ৪২টি বিতর্কে অংশ নিয়ে যিনি প্রায় ৩৬ হাজার শব্দ ভাষণে খরচ করেছিলেন, তাঁর মুখই কুলুপ আঁটা হয়ে রইল! লোকসভায় এমন দৃশ্যও তো আমরা দেখেছি, আদভানি কিছু বলার জন্য আসন ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন, অথচ তাঁকে হাত ধরে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

দেয়াললিখন পড়তে না পারার ব্যর্থতা কি আদভানির নয়? মার্গদর্শক কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল তাঁকে। পাঁচ বছরে একবারের জন্যও মিটিং ডাকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। লোকসভার ‘এথিকস কমিটির’ চেয়ারম্যানও তিনি। অথচ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে পড়া সাংসদদের কমিটির সামনে হাজির করানোর কোনো উদ্যোগ তাঁকে নিতে দেওয়া হয়নি। এত অপমান ও উপেক্ষা সত্ত্বেও কেন এত দিন চুপ করে ছিলেন? কেন এই বোধোদয়টুকু হয়নি যে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তবে কি তিনি ভেবেছিলেন মালয়েশিয়ার নবতিপর মাহাথির মোহাম্মদের মতো তাঁর ভাগ্যেও একদিন না একদিন শিকে ছিঁড়বে? হতে পারবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী?

এই অসম্মান অবশ্যই লালকৃষ্ণ আদভানির প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু নিজেকে ওই পর্যায়ে নামিয়ে আনার দায়ও তাঁরই। দেয়ালের লিখন অথবা মোদির মন বুঝতে না পারা তো তাঁরই ব্যর্থতা।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি