টাকা মানুষের, খবর সরকারের

এক মিনিট আর চার মিনিট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক এক মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতারের প্রধান বুলেটিনে এই ছিল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর খবরের মোট হিস্যা। আওয়ামী লীগ আর জোটসঙ্গীদের জন্য বরাদ্দ সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে বিটিভির হিসাবটা দাঁড়ায় ৩৬১ মিনিট বনাম ১ মিনিট। আর বেতারে হিসাবটা ২৪৯ মিনিট বনাম ৪ মিনিট।

নির্বাচনের আগে আর পরে এক মাসের প্রধান বুলেটিন ও সংবাদ পর্যালোচনা এবং নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে প্রথম আলো এ হিসাব পেয়েছে। গণমাধ্যম দুটি চলে জনগণের টাকায়, কিন্তু পরিচালিত হয় সরকারের অধীনে। এখানে খবর বাছাই বা খবরের গুরুত্ব নির্ণয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি পক্ষপাত সুস্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের কথায়, এ প্রবণতা নতুন কিছু নয়। বেতার ও বিটিভি বস্তুত ক্ষমতাসীন দলের চ্যানেল এবং মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে।

নির্বাচনী খবর ও পর্যালোচনায় সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল-জোটের অনুপস্থিতি হচ্ছে এ প্রবণতার একটি দিক। প্রথম আলো আরও দেখেছে, এমনকি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তৎপরতার খবরও খুব কম জায়গা পেয়েছে। নির্বাচনী মামলা-হামলা বা অনিয়মের বিষয়ে কোনো খবরই হয়নি। নির্বাচনের পরে বেড়ে গেছে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে’ ধাঁচের খবর। তখন খবর সরকারময়। কেউ সরকার বা নির্বাচনের সমালোচনা করলে সেটা সংবাদ হয়নি। অথচ সরকারদলীয় নেতা যখন সেই সমালোচনাকে নিন্দামন্দ করেছেন, সেটা খবর হয়েছে। খবরে ঢুকেছে সরকারতোষী মন্তব্য।

তবে বিটিভি-বেতারের এসব নির্বাচনী খবরে মানুষজনের আগ্রহ ছিল না। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে রাজধানীর নানা জায়গায় নানা বয়সী ২০ জন পথচলতি মানুষের সঙ্গে আলাপ করে তেমনটাই জানা গেছে। একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের চালক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের সময় বিটিভি দেখিনি। অন্য চ্যানেল দেখেছি। সরকারের এই চ্যানেল দেখে কোনো লাভ নাই, লসও নাই।’ সরকারের খবর ছাড়া অন্য খবর থাকে না বলে রফিকুল বিটিভি দেখেননি। তাঁর সোজা হিসাব, সরকারের উন্নয়নের খবর জানতে চাইলে বিটিভি দেখা যেতে পারে।

প্রথম আলো গত ২২ ডিসেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারি সময়কালে মাধ্যম দুটির নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট খবর ও কিছু অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করেছে। বিটিভিতে রাত আটটার খবরের ২৭ দিনের এবং বেতারে রাত সাড়ে আটটার খবরের ২৯ দিনের সময় মাপা হয়েছে।

প্রথম আলোর দুই পর্যবেক্ষক আরও দেখেছেন আর শুনেছেন নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠান, সরকারের উন্নয়নকাজ নিয়ে আলোচনা-আলেখ্য, প্রচারণাধর্মী গান ও প্রামাণ্যচিত্র। বিটিভিতে দেখা বুলেটিনের মোট সময়কাল ছিল ৮২০ মিনিট। এর প্রায় অর্ধেকজুড়ে ছিল নির্বাচন-সংক্রান্ত খবর। বেতারে শোনা বুলেটিনের মোট সময়কাল ছিল ৭২৫ মিনিট, নির্বাচন-সংক্রান্ত খবরের হিস্যা অর্ধেকের কিছু কম। কোনোটিতেই বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বীদের খবর নির্বাচন-সংক্রান্ত খবরের এক শতাংশের বেশি দখল করতে পারেনি। আর নির্বাচনী খবরে সরকারি দল-জোটের হিস্যা ৮০ শতাংশের বেশি থেকেছে।

ইসির তৎপরতার ভাগে জুটেছে ১০ শতাংশের কম সময়। গুরুত্বও জুটেছে কম। যেমন বিটিভিতে এ সময়কালে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে ৮৫টি, তিন-চতুর্থাংশই আওয়ামী লীগ বা তার জোটসঙ্গীদের খবর নিয়ে। তারপরই অবশ্য শিরোনামে স্থান পেয়েছে ইসির খবর, তবে মাত্র ১৫টি অর্থাৎ ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ বেতারে পরিস্থিতি যৎকিঞ্চিৎ ভালো। সরকারপ্রধান বা ক্ষমতাসীনদের খবর অধিকাংশ সময় বুলেটিনের প্রথম অংশে জায়গা পেয়েছে।

নির্বাচনের আগ দিয়ে প্রায় প্রতিদিন তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথা খবরে গুরুত্ব পেয়েছে। নির্বাচনের পর তাঁর গুরুত্ব কমতে থাকে। ৭ জানুয়ারির পর বুলেটিন থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পর তাঁর জায়গা নেন নতুন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

খবর নেই, প্রতিক্রিয়া আছে

নির্বাচনের প্রচারণাপর্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিরোধী জোটের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটির কথা বিটিভি বা বেতারের খবরে স্থান পায়নি। বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা দেওয়া, প্রচারণাকালে বিএনপির প্রার্থী আটক, গায়েবি মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও খবরে আসেনি।

ইসি, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সমান মাঠ বা সমান সুযোগ সৃষ্টি করছে না—বিএনপি জোটের নেতাদের এসব অভিযোগের কথা বিটিভি-বেতারে আসেনি। অথচ ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের যেকোনো অভিযোগ খবর হয়ে গেছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক সংবাদ সম্মেলন নিয়ে খবর হয়নি। কিন্তু সেখানে বলা কথার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতারা বক্তব্য দিলে সেটা ঠিকই খবর হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে গত ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বিটিভি ও বেতার তা নিয়ে খবর করেনি। তবে এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ১৬ জানুয়ারি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের দেওয়া বক্তব্য খবর হয়েছে।

‘ভোট ভাবনা’ ও ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’

নির্বাচনের আগে বিটিভিতে বুলেটিনের মধ্যে আলাদা করে খবরের গুচ্ছ সম্প্রচারিত হয়। একটির নাম ছিল, ‘নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে শিল্পী সমাজের ভাবনা’। এটি তিন দিন ধরে চলে। এখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বলতে দেখা যায়, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে ভোট দেবেন।

বাংলাদেশ বেতারে খবরের শেষ অংশে সংবাদ পর্যালোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে সরকারের উন্নয়নকাজের খবর। ফলাও করে এসেছে ভোটের ‘উৎসবমুখর পরিবেশ’ জারি থাকার কথা। নির্বাচনের দিন বেতারের প্রতিবেদক তাঁর খবরে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র ভোটাররা নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিয়েছেন। প্রথমবারের মতো ছয়টি আসনে ইভিএমে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক নারীর উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করেছে। নারীর যে ক্ষমতায়ন হয়েছে, আমরা সেটি দেখছি।’ এই ধারার প্রতিবেদন বিটিভিও করেছে। আর নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বুলেটিনজুড়ে ছিল ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ নিয়ে খবরের ছড়াছড়ি।

উন্নয়ন আর অভিনন্দন

নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও দুই গণমাধ্যমের খবরে নিয়মিত উঠে এসেছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু প্রকল্প আর বিদ্যুতায়নের প্রসারসহ সরকারের বিভিন্ন বড় উন্নয়ন প্রকল্পের খবর। থেকেছে উন্নয়ন নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান। নির্বাচনের আগের দিন, অর্থাৎ গত ২৯ ডিসেম্বর বিটিভিতে এমন একটি অনুষ্ঠানের শেষে পর্দায় লেখা ভেসে ওঠে, ‘আপনি কোন পথটি বেছে নেবেন, সন্ত্রাস নাকি সমৃদ্ধি’? একই দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের আয়োজনে ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামের একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছে বিটিভি। এতে দেড় ঘণ্টা ধরে আলোচকেরা সরকারের উন্নয়নকাজের প্রশংসা করেন। বেতারেও প্রচার করা হয়েছে এমন অনুষ্ঠান।

নির্বাচনের পরদিন থেকে শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের অভিনন্দন জানানোর খবর। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সমালোচনা করেছিল। তবে বিটিভি ও বেতারের খবরে সেগুলোর আভাসও ছিল না।

এসব কথার প্রসঙ্গে গণমাধ্যম বিশ্লেষক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেছেন, এই দুটি গণমাধ্যমকে সত্যিকারের গণমাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অতীতে সরকারকে অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। এ দুটি এখন বিরাষ্ট্রীয়করণ করে বেসরকারি খাতে বিক্রি করা দরকার। চাইলে আওয়ামী লীগও এটা কিনতে পারে। তাঁর মতে, এভাবে জনগণের অর্থের অপচয়ের কোনো মানে হয় না।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক গীতি আরা নাসরীনের মতটা অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলছেন, একটি স্বাধীন কমিশনকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বিটিভি ও বেতারকে যথার্থ জনসেবামূলক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানে (পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার) রূপান্তর করা উচিত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের গঠিত কমিশন একই সুপারিশ করে বিটিভি-বেতারকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে বলেছিল। ফল হয়নি। একই রকম নিষ্ফলা রয়ে গেছে নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী তিন জোটের প্রতিশ্রুতি আর ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগ।

[প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ বার্তা ব্যবস্থাপকেরা গণমাধ্যম বিশ্লেষক ড. ফাহমিদুল হকের সঙ্গে পরামর্শ করে আধেয় বা কনটেন্ট বিশ্লেষণের সূচক নির্ধারণ করেন। সূচকের ছক ধরে বার্তা ব্যবস্থাপকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে পর্যবেক্ষণ করেন খণ্ডকালীন কর্মী মো. মাসুদ আল মাহ্দী ও তাজওয়ার মাহমিদ]

মোজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক