ভ্রমণ কি শুধুই অবলোকন?

‘নতুন কোনো শহরে একাকী ঘুম থেকে জাগা
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি।’
—ফ্রেয়া স্টাক

ইদানীং ভ্রমণ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কি দেশের ভেতরে, কি বাইরে। বয়স্ক ব্যক্তিরা উৎসাহী বেশি। পর্যটকদের ভিড়ে প্রবীণদের সংখ্যাধিক্য লক্ষণীয়। এই উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের সিনিয়র সিটিজেনরা দলে দলে আসেন। কেন প্রবীণেরা? কারণ অবসর, ঔৎসুক্য এবং সন্তোষজনক আর্থিক সংগতি। এবার বোনেরা (কমবেশি সবাই অবসরপ্রাপ্ত) মিলে দিল্লি-আগ্রা ঘুরতে গিয়ে প্রবীণদের দল দেখে বোন বাণী দিল, ‘এই যে ঘুরে বেড়ানো, হাঁটাহাঁটি, নতুন কিছু উন্মোচনের শিহরণ—এ কেবল ভিনদেশ অবলোকন নয়, এতে শরীরের সক্রিয়তা, জীবনীশক্তি ও আয়ু বৃদ্ধি পায়।’

পেশাজীবন শেষ করে ঘুরে বেড়ানোতে পিছুটান একটু কম থাকে। নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণ উপভোগ করা যায়। বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে এটা আরও ইতিবাচক। সমমনা নারীরা দলে দলে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে পুরুষ না থাকলে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের হ্যাপায় হাঁপিয়ে ওঠার আশঙ্কা কম থাকে। রজঃনিবৃত্তিও একধরনের প্রতিবন্ধকতাহীনতা। উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের মা–বাবারাও পরিণত বয়সে একা হয়ে পড়ছেন। ভ্রমণসংগতি আছে এমন প্রবীণদের ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই বিদেশবিভুঁইয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, নাহয় অভিবাসী হয়ে পড়ছেন। যৌক্তিক–অযৌক্তিক অনেক কারণ দেখিয়ে বেশির ভাগই আর ফিরতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে, ক্রয়ক্ষমতা সন্তোষজনক, সুস্থতাও দীর্ঘায়ু পাচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের থলে এ সরকার যথেষ্ট পুষ্ট করে ছেড়ে দিয়েছে। সুতরাং ঘাসের ডগার শিশির বিন্দু তালিকায় রেখেও কুতুব মিনারের
ডগায় শঙ্খচিল দেখার সূচি করে রাখা যায়। তো চরৈবেতি চরৈবেতি।

ভ্রমণে ভ্রমণসঙ্গী নির্বাচন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনীষী এ রকম বলেন, ‘ভ্রমণসঙ্গী হতে হবে হয় সমমনা, না হয় আরও উচ্চমনা। এ রকম পাওয়া না গেলে একাই সই।’ অন্যদিকে ভ্রমণ আর পরিব্রাজন এক কথা নয়। ভ্রমণকারী দেখেন, সৌন্দর্য উপভোগ করেন। পরিব্রাজক খোঁজেন, আবিষ্কার করেন, ব্যাখ্যা করেন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল অনুসন্ধান করেন। তঁার আত্মোপলব্ধি ঘটে। অভিজ্ঞতা ও উদারতায় সমৃদ্ধ হন। এক নারী ভ্রমণকারী দলের সঙ্গে আমাদের কুয়াকাটা সৈকত বেড়িয়ে এলেন। কেমন লাগল জিজ্ঞাসা করলে ঠোঁট উল্টিয়ে বললেন,

‘কী জানি বাপু, কোথাও তো কাউকে কুয়া কাটতে দেখলাম না।’

মনীষী বলেন, পর্যটনই একমাত্র জিনিস, যা কিনে তুমি ধনী হতে পারো। বলা বাহুল্য, এ ধন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নয়। নিজেকে সমৃদ্ধ করা। তাই ভ্রমণপ্রবণতা মানুষের মাঝে বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু কেবল কেনাকাটা আর সমালোচনায় আবর্তনের আকাঙ্ক্ষা যেন ভর না করে। প্রকৃত ভ্রমণ আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা ও ধৈর্য শিক্ষা দেয়। একবার সরকারি সফরে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে এক কর্মকর্তা শ্রীলঙ্কা গেলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকেই চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে ছি ছি করতে লাগলেন। কেন? না, সেখানকার মায়েরা এত নির্লজ্জ! কেউ ওড়না পরে না! ভাগ্যিস গ্রীষ্মকালে ইউরোপ, আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পাননি। পেলে নির্ঘাত রাস্তাঘাটে মূর্ছা যেতেন।

পর্যটক সাদি বলেন, ‘পর্যবেক্ষণহীন পর্যটক পক্ষহীন পাখির মতো।’

যে দেশ দেখার ইচ্ছা, সবচেয়ে ভালো ভ্রমণের আগে সেই দেশের ইতিহাস, প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে যাওয়া। ভ্রমণ নাকি পৃথিবীর কাছে মানুষ কত ক্ষুদ্র, তারও চেতনা জাগায়। সুতরাং একজন প্রকৃত পরিব্রাজক তাঁর চরিত্রের ক্ষুদ্রতাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠার রসদ সংগ্রহে রাখেন। কিন্তু যাঁদের ভ্রমণের সুযোগ নেই, তাঁরা কি শুদ্ধতার পাঠ নিতে পারবেন না? পারবেন। একজন পর্যটক ভ্রমণ শেষে কেবল নিজেই নিজের মধ্যে রসাস্বাদন না করে যিনি ভালো বর্ণনা করতে পারেন বা লিখতে পারেন, তাঁর দায়িত্ব সুযোগবঞ্চিতদের মধ্যে মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ। কিন্তু যে ভ্রমণকারী চারিত্রিকভাবে নেতিবাচক, তিনি উন্নত দেশ থেকে ঘুরে এসে ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে বর্ণনা শুরু করলে তাঁকে পরিব্রাজনপিপাসুরা প্রথমেই পরিত্যাগ করুন।

উম্মে মুসলিমা সাহিত্যিক