চা-কফির বিল নিয়ে একপ্রস্থ

প্রথম আলোয় ২৩ মার্চ ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত এক খবর বেশ সাড়া ফেলেছে। খবরের শিরোনাম ‘চা-কফির বিল দেন না ওসি’। অনলাইনে খবরটির নিচে ১০৩টা মন্তব্য।

খবরের শিরোনাম পড়ে মনে হলো, এটা কি আসলে খবর! খবর হতে গেলে ঘটনাকে অস্বাভাবিক হতে হয়। পাঠ্যপুস্তকে নাকি লেখা থাকে, কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা খবর। ওসি বিল না দিলে কি সেটা খবর? নাকি বিল দিলে সেটা খবর?

যেহেতু বিল না দেওয়ার ঘটনা খবর হয়েছে, তার মানে দাঁড়াচ্ছে, দেশ বেশ উন্নত হয়েছে। এখন ক্ষমতাবানেরাও চা-শিঙাড়ার বিল দিয়ে থাকেন। একজন দেননি। তার প্রতিবাদ করতে সাহস পেয়েছেন চা-বিক্রেতা। তাই তা খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

নরসিংদীর পলাশ থানার খবরটা ভালোভাবে পড়লাম। পড়ে বুঝলাম, আসলে ঘটনা বেশ জটিল। ইটস কম্প্লিকেটেড। ওসি সাহেব নিজে তো আর চা-শিঙাড়া খাননি, অনেকেই খেয়েছেন। তার মধ্যে ওসি সাহেবের অধীনেরাও আছেন। তাঁরা চা খেয়েছেন, শিঙাড়া খেয়েছেন আর বলে গেছেন, বিল দেবেন ওসি সাহেব। এখন ২ হাজার ৩০৫ টাকা বিল বাকি পড়ে গেছে। চা-বিক্রেতা গেছেন ওসি সাহেবের কাছে। ওসি সাহেব বলেছেন, ‘আমি কখন এত টাকার চা-শিঙাড়া খেলাম! আমি স্লিপ না দিলে কাউকে আমার নামে বাকি দিবা না।’

আমি ওসি সাহেবের এই যুক্তিকে ফেলনা ভাবছি না। এ রকম হতে পারে।

একটা কৌতুক প্রচলিত আছে।

একজন ট্রাফিক পুলিশ আটকাল একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে।
লাইসেন্স দেখি।
লাইসেন্স নাই।
তাহলে মোটরসাইকেল থানায় জমা রাখতে হবে। লাইসেন্স দেখিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাবেন।
স্যার, ছেড়ে দেন। স্যার, এরপর লাইসেন্স না নিয়ে বের হব না। স্যার, আমার কাছে এক শ টাকা আছে স্যার। এটা জমা রাখেন...
ট্রাফিক পুলিশ তো আর নিজ হাতে টাকা রাখতে পারে না। চারদিকে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা। কে না কে ভিডিও করে রাখে! পুলিশ বলল, ওই যে মুদিদোকান দেখা যাচ্ছে, ওখানে গিয়ে টাকাটা দিয়ে যান।
মোটরসাইকেল আরোহী মুদিদোকানে গেলেন। গিয়ে বললেন, ওই ট্রাফিক পুলিশ স্যার বলেছেন আমারে এক শ টাকা দিতে।
মুদিদোকানি তখন হাত ইশারা করলেন পুলিশের দিকে।
পুলিশ হাত নেড়ে সম্মতি জানাল।
মুদিদোকানির কাছ থেকে এক শ টাকা নিয়ে মোটরবাইক আরোহী চলে গেলেন।
কৌতুক এখানেই শেষ।

এখন পরবর্তী ঘটনা কল্পনা করুন। একটু পরে ট্রাফিক পুলিশ যাবে মুদিদোকানির কাছে। গিয়ে বলবে, দাও আমার এক শ টাকা।
আর মুদিদোকানি বলবেন, স্যার, আমি গরিব মানুষ, আমার এক শ টাকা দিয়া দেন।
এখন যদি পুলিশ এই এক শ টাকা মুদিদোকানিকে না শোধ করে, তাহলে কি এটাকে অন্যায় বলা যাবে? কে দায়ী আসলে? ট্রাফিক পুলিশ, মোটরসাইকেল আরোহী নাকি মুদিদোকানি?

ট্রাফিক পুলিশের নিশ্চয়ই দায় আছে। কিন্তু মোটরসাইকেল আরোহীরও কি দায় নেই? তিনি কেন লাইসেন্স ছাড়া বাইক চালাবেন? আর মুদিদোকানি? এখন পর্যন্ত বোকামি ছাড়া তাঁর আর কোনো দোষ অবশ্য আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু তিনি যদি মোটরসাইকেল আরোহীর কাছ থেকে এক শ টাকা নিয়ে সেটা পরে পুলিশ সদস্যকে দিতেন, তাহলে আমরা বলতাম, তিনিও এই চক্রের একটা অংশ। দুষ্টচক্রও একে বলা যাবে।

বাংলাদেশে বহু ক্ষেত্রে কিন্তু এটাই হচ্ছে। প্রথম দোষ করি আমরা। সাধারণ নাগরিকেরা। আমরা আইন ভঙ্গ করি। তারপর ধরা পড়লে দুই নম্বরি করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি। নিজেকে বাঁচাই। ‘সিস্টেম’ করে নিই। এরপর দায়ী আইন প্রয়োগকারীরা। তাঁরা ওই ‘সিস্টেম’ করাটাকে উৎসাহিত করেন। তাতে তাঁদের খানিকটা লাভ হয়। খানিকটা বা অনেকটা লাভ। তিন নম্বর দায়ী বাকি মানুষ। যারা এই ‘সিস্টেম’টা চলতে সাহায্য করে। অনুমোদন করে। সহ্য করে। প্রতিবাদ করে না।

নরসিংদীর ওই থানার মাত্র ২ হাজার ৩০৫ টাকার ঘটনা কিন্তু জটিল হয়ে যাচ্ছে। খবরের কাগজে ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। তা-ও যেমন-তেমন কাগজ নয়, প্রথম আলো। এসপি সাহেবকে ঘটনা জানানো হয়েছে। এসপি সাহেব বলেছেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাওনা যাতে দোকানি পান, সেই ব্যবস্থা করা হবে। তবে দোকান বৈধ কি না, তা-ও দেখা হবে।

হায় রে! এখন বাংলাদেশে যদি মুদিদোকান, চা-শিঙাড়ার দোকানের বৈধতা দেখে পাওনা দিতে হয়, দোকানের যদি ট্রেড লাইসেন্স না থাকে, মূসক নিবন্ধন না থাকে, দোকানের জায়গা যদি সরকারি হয়ে থাকে, তাহলে যদি দোকানির জিনিস খেয়ে দাম না দেওয়ার অধিকার জন্মায়, তাহলে তো কোনো মুদিদোকানিই আর কোনো দিন কোনো টাকা পাবেন না। কোনো মুচি পাবেন না, কোনো সাইকেল মেকানিক পাবেন না, কোনো চটপটিওয়ালা পাবেন না!
বটে!
এই দেশে শুধু গরিবের পাওনা পরিশোধের সময় বৈধ-অবৈধ ব্যাপারটা আসে। আর বড় বড় ক্ষেত্রে?
কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে আসবে।
এই দেশে কতজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ইতিহাসে স্থায়ীভাবে নাম রেখে গেল, আর চা-শিঙাড়ার দোকানের বৈধতা আর অবৈধতার প্রশ্ন আসছে।

১৯৮০-এর দশকে এরশাদ সাহেব অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। তারপর ভিআইপি রোডের দুই ধারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা শুরু হলো। তখন যায়যায়দিন পত্রিকায় একজন রিকশাওয়ালার জবানিতে বলা হলো, আচ্ছা স্যার কন তো দেখি, অবৈধ দোকানপাট নিয়া যদি ভিআইপি রোডে দোকান রাখা না যায়, তাইলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল কইরা ক্যামনে ভিআইপি রোড দিয়া সাইরেন বাজায়া চলাচল করা যায়!

আচ্ছা, এই খবরটা পড়ে আপনাদের মনে কোন ব্যাপারটা দাগ কেটেছে। দেশটা চলেছে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে। তা না হলে চায়ের দেশে গ্রামের দোকানে কফিও বিক্রি হয়! আর বিল কোনো ব্যাপার নয়, কিল যেন না পড়ে। ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা তাড়া। আর কিছু? আর হলো, কত বড় বড় বিলখেলাপি সামনে দিয়ে চলে গেল, আর এইটা নিয়ে আমরা লেবু–তিতা করছি কেন!

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক