বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ

বাতাসে লাশের গন্ধ। পোড়া লাশের গন্ধ। গাড়িচাপা লাশের গন্ধ। ভবনধসে চাপা পড়া লাশের গন্ধ। গুলিতে মরা নদীর ধারে পড়ে থাকা হাত–পা বাঁধা লাশের গন্ধ। রোগাক্রান্ত লাশের গন্ধ। কারও ক্যানসার, কেউবা লিভারের রোগী ছিলেন। কেউ কিডনি বিকল হওয়ার শিকার। কখনো সাভারের রানা প্লাজা, তো কখনো আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন। একবার নিমতলী, তো এরপর চকবাজার। চকবাজারের শোক কাটাতে না কাটাতেই বনানী অগ্নিকাণ্ড গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম—এ পর্যন্ত ২৫ জনের অঙ্গার হওয়া লাশ।

দেশের বাসাবাড়ি, সুউচ্চ ভবন, রাজপথ, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু—সব যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর ফাঁদ। লাশের গন্ধে চারদিক ভারী হয়ে উঠছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। শবযাত্রায় যুক্ত হচ্ছে নতুন লাশ। গণমাধ্যমের হিসাব অনুসারে, বুধবার সারা দেশে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৫০–এর অধিক নিহত হয়েছে। সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের সংবাদ দিয়ে শুরু। রাতে এফআর ভবনের লাশের হিসাব গুনে ঘুমাতে যাওয়া। ঘুম? হায় ঘুম।

এক অপরিকল্পিত, লোভী, দুর্নীতিবান্ধব উন্নয়ননীতির খপ্পরে পড়েছে দেশ। ঘটনা, দুর্ঘটনা, রোগব্যাধির মহামারি চলছে। জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব ও সমবণ্টনের উন্নয়ননীতি কোথাও নেই। প্রশাসন আইনের প্রয়োগ করতে পুরোপুরিই ব্যর্থ। তথাকথিত এই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে কেবল সমাজের অভিজাতরাই। মাঝেমধ্যে যারা ছিটাফোঁটা ভাগ পাচ্ছে, তারাও অভিজাতে পরিণত হচ্ছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই করুণ। মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেঘোরে মারা পড়ছে পথেঘাটে, নদীতে, ভবনে। জীবনের দাম দুর্ঘটনার পর কয়েক লাখ টাকায় নেমে এসেছে। একটি দুর্ঘটনামত্ত, রোগব্যাধিগ্রস্ত ও অপরাধী সমাজের বিকাশ ঘটছে।

দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, এর লাভ কী, যদি জীবনেরই নিরাপত্তা না থাকে। যে জীবন পুড়ে যাওয়ার, গাড়িচাপা পড়ার, উন্নয়নের ফল ভোগ করার আগেই অপঘাতে ফুরিয়ে যাওয়ার, সে জীবনের মূল্য কোথায়? প্রশ্ন হচ্ছে, কীসের জন্য এত উন্নয়ন, কার জন্য এই উন্নয়ন? এই ঝাঁ চকচকে সুউচ্চ ভবন, প্রশস্ত তকতকে মহাসড়ক বা বিশাল বিশাল সেতু; অবশ্যই উন্নয়নের মাপকাঠি। অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দেয় এসব। কিন্তু সেই ভবনে গিয়ে যদি পুড়ে মরতে হয়, মহাসড়কে গিয়ে যদি দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, তবে এই উন্নয়নের মূল্য কোথায় রইল। অভিশপ্ত এই উন্নয়ন থেকে মেঠো পথ আর কুঁড়েঘরই তো ভালো ছিল।

এ জন্য আজকাল বলা হয়, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই হবে না, এর সঙ্গে সুশাসনও জরুরি। তবেই টেকসই উন্নয়ন হবে। নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। দেশে সুশাসন থাকলে রানা প্লাজায় কারখানা থাকত না, তাজরীনের জরুরি নির্গমনের পথ থাকত। সড়কে নিয়ন্ত্রণ থাকত। খাবারে বিষ থাকত না। বাতাস থাকত পরিশুদ্ধ। বনানীতে গায়ে গা ঘেঁষে এতগুলো সুউচ্চ ভবন নির্মিত হতো না। এফআর ভবনে অগ্নিনির্বাপণের উন্নত সুবিধা থাকত। দেশের অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর আরও আধুনিকায়ন হতো। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি থাকত। সুশাসন না থাকলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখিয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে কৃতিত্ব জাহির করা যাবে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামবে না।

বনানীতে ফায়ার সার্ভিসের পাইপের ফুটো চেপে ধরা সেই বালকের ছবিটি দেখেছেন নিশ্চয়ই। এটা একটি প্রতীকী ছবিমাত্র। আদতে আমাদের রাষ্ট্রের বিশাল বিশাল ফুটো রয়েছে। সেই সব ফুটো চেপে মেরামত করছে চাইছে নাগরিকেরা। কিন্তু সর্বগ্রাসী এক দুর্নীতিবান্ধব প্রশাসন ও উন্নয়ননীতির কারণে পারছে না। এসব ফুটো মেরামত না করলে নাগরিকেরা কোনো দিনই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে না। এই সব ফুটো মেরামত করা জরুরি এবং দ্রুতই। মিথ্যা কথার মৃত্যুনগরীর বাতাস থেকে লাশের গন্ধ দূর করতেই হবে।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৭৯ সালে লিখেছিলেন, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। সে ছিল ভিন্ন সময়, ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এখনো বাতাসে লাশের গন্ধ পাওয়া যায়, অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন, ‘ঘুম আসে না’। এখনো স্বজনহারা অনেকেরই ঘুম আসে না।

‘এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না—
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুণ্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারি না, আমি
ঘুমুতে পারি না…’

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন