উদিত দুঃখের দেশে স্বাগত!

রাজধানীর বনানীর বহুতল ভবন এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে তার বেয়ে ওপর থেকে নিচে নামতে থাকেন কয়েকজন। এ সময় এক ব্যক্তি হাত ফসকে পড়ে যান। গতকাল বেলা দুইটায়।  ছবি: সাজিদ হোসেন
রাজধানীর বনানীর বহুতল ভবন এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে তার বেয়ে ওপর থেকে নিচে নামতে থাকেন কয়েকজন। এ সময় এক ব্যক্তি হাত ফসকে পড়ে যান। গতকাল বেলা দুইটায়। ছবি: সাজিদ হোসেন

ছবিটা দেখেছেন? একটি ভবন থেকে টুপ টুপ করে পড়ছে মানুষ। আঘাতপ্রাপ্তির নিশ্চিত সম্ভাবনা সত্ত্বেও তাঁরা লাফ দিয়েছিলেন। কারণ আগুন ও কালো ধোঁয়ায় পুড়ে শেষ হতে চাননি তাঁরা। জীবিত থাকার সীমিত সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কারও কারও ভাগ্যে আর ‘জীবন’ ফিরে আসেনি।

বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পড়ন্ত বস্তুর তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম সূত্রে বলা হয়েছে, স্থির অবস্থান হতে বিনা বাধায় পড়ন্ত সব বস্তু সমান সময়ে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে। বিনা বাধায় বলতে গ্যালিলিও বুঝিয়েছিলেন, বস্তুর ওপর অভিকর্ষ বল ছাড়া অন্য কোনো বল কাজ করবে না। তবে পড়ন্ত বস্তুর সংজ্ঞায় নিশ্চয়ই মানুষের কথা ভাবেননি গ্যালিলিও। এ দেশে গতকাল বৃহস্পতিবার মানুষই পড়েছে ‘পড়ন্ত বস্তু’ হয়ে। সেখানে অভিকর্ষ বল ছাড়াও কাজ করেছিল মৃত্যুভয়। এমন ভয়ের অনুভূতির প্রাবল্য সত্যিই বেশি।

ঢাকায় বনানীর এফ আর টাওয়ারে গতকাল ভয়াবহ আগুন লাগে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতের তালিকায় যোগ হয়েছে ২৫টি লাশ। পুলিশ বলছে, এর বাইরে আর কোনো নিখোঁজ ব্যক্তি নেই। মনে চূড়ান্ত মৃত্যুভয় নিয়ে আহত হয়ে বেঁচে গেছেন ৭৩ জন। আগুন ও কালো ধোঁয়ার দুঃস্বপ্ন তাঁরা আদৌ ভুলতে পারবেন কি না, কে জানে।

আমাদের দেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। এবারও আসছে। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বনানীর এফ আর টাওয়ারে নাকি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না ওই ভবন থেকে বেরিয়ে আসার জরুরি কোনো পথ। এফ আর টাওয়ার ও এর আশপাশের ভবনগুলো ছিল একেবারেই লাগোয়া। অর্থাৎ দুই ভবনের মধ্যে যে সামান্য ফাঁকা জায়গাটুকু প্রয়োজন, তা-ও নাকি যথেষ্ট ছিল না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, যেকোনো ভবন সাততলার ওপর হলেই সেটিকে বহুতল ভবন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই হিসাবে ২৩ তলা এফ আর টাওয়ারও বহুতল ভবন। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, ফায়ার এক্সিট বা আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জরুরি নির্গমন পথ থাকলে এফ আর টাওয়ারে হয়তো এত প্রাণহানি ঘটত না। কিংবা আগুন নেভানোর নিজস্ব ভালো ব্যবস্থা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি এতটা হতো না। প্রশ্ন হলো, এত বড় একটি ভবন তৈরি হলো, সেখানে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো ভাড়া নিল এবং কাজও শুরু করে দিল কিন্তু তাতে যে আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই, সেটি দেখবে কে? দেখার দায়িত্ব কার?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র বলছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব ভবনমালিককে নিতে হবে। ‘নিজের নিরাপত্তা নিজেরা বিবেচনা করে দেখার’ বলে অনুরোধ করেছেন তিনি। মেয়র এও স্বীকার করে নিয়েছেন, সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। আর সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আচ্ছা, এই কথাগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে না? দোষারোপের গন্ধ আছে কথাগুলোয়। দুর্ঘটনার দিনে এ দেশে শেষ ঢাল সব সময়ই ‘দোষারোপের রাজনীতি’। এক পক্ষ বলবে, ‘ও ঠিকভাবে কাজ করলে এমনটি হতো না।’ আরেক পক্ষ বলবে, ‘সে কেন করল না?’ দুই পক্ষই জানে, নিজেরা একটা ভালো ঝগড়ায় জড়ালে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাবে! কারণ আমরা বাহাস খুব ভালোবাসি, জটলা করে দেখি। ওতেই আমাদের কৌতূহল ব্যাপক, তাতে সময় নষ্ট হলে হোক!

জনতার ভিড়ের কারণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধারকারী ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সদস্যদের। ছবি: প্রথম আলো
জনতার ভিড়ের কারণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধারকারী ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সদস্যদের। ছবি: প্রথম আলো

আমাদের কৌতূহলী মন কখনো কখনো যে সর্বনাশারূপে আবির্ভূত হয়, তাও কিন্তু সত্যি। জানা গেছে, গতকাল এফ আর টাওয়ারে উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। পানিবাহী গাড়িগুলোর ভিড় ঠেলে যেতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছিল। যে সময়ে কিছু ক্ষেত্রে ১ সেকেন্ডে ১টি প্রাণ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তখন নষ্ট হওয়া সময়ের দাম অনেক। অথচ ‘আল্লাহর দোহাই লাগে গাড়ি যেতে দেন’ বলেও মানুষের জটলা তৈরির উৎসাহে ভাটার টান আনা যায়নি। পুলিশের সদস্যরা বারবার চেষ্টা করেও তাদের খুব বেশি দূরে সরাতে পারছিলেন না। সব দেখে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে—এ দেশে কৌতূহল দামি, নাকি মানুষের জীবন?

সিটি করপোরেশন বলছে, এখন থেকে অ্যাকশনে নামা হবে। বহুতল ভবনের আনুষঙ্গিক কাগজপত্র রাজউকের কাছে চাওয়া হয়েছে। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শেষ বাক্যটি বহুল চর্চিত। চুড়িহাট্টায় ৭১টি প্রাণ পুড়ে ভস্ম হওয়ার দিনও আমরা এমন কথা শুনেছি। শুনেছি নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের সময়ও। তার পরও চুড়িহাট্টা দেখতে হয়েছে, ঢাকার বাতাসে মিশেছে পোড়া লাশের গন্ধ।

বনানীর বহুতল এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার সূত্রপাত হয় দুপুর ১২টার দিকে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধারকর্মীরা যখন ভেতরে গেলেন, তখনই বের হতে থাকে একের পর এক লাশ। ছবি: আবদুস সালাম
বনানীর বহুতল এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার সূত্রপাত হয় দুপুর ১২টার দিকে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধারকর্মীরা যখন ভেতরে গেলেন, তখনই বের হতে থাকে একের পর এক লাশ। ছবি: আবদুস সালাম

প্রতিটি মৃত্যুই অনাকাঙ্ক্ষিত। আর তা অপঘাতে হলে, মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। কিছুদিন ধরেই এ দেশে একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। যেন মৃত্যুর দোকানে শুরু হয়েছে বৈশাখী সেল! অনিয়ম ও অসচেতনতার দামে তা কিনছি আমরা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবরার ১৯ মার্চ সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কাছে বাসের চাপায় নিহত হন। জেব্রা ক্রসিংয়ের সাদা রং সেদিন ছোপ ছোপ রক্তে রাঙা হয়েছিল। পরে জানা গেছে, আবরারকে চাপা দেওয়া বাসটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী, চালক নন। আর গতকাল সারা দেশে শুধু সড়কেই জান গেছে ২৩ জনের। মৃত্যু কত সহজলভ্য এখানে!

তার পরও আমরা জীবন কাটাই, কাটিয়ে দিই আর কি। দুঃসময় পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেই শুরুটায় যেন আগের মতো গলদ না থাকে। বদলের সুর যেন থাকে। কবি আবুল হাসান তাঁর ‘উদিত দুঃখের দেশ’ নামের কবিতায় সুসময় ফেরানোর ডাক দিয়েছিলেন। আরেক কবিতায় জানিয়েছিলেন বদলের আহ্বান। কবির ভাষায়-

‘কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে
মাটির কনুই, ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে...’

- বদলে যাও, নিজেকে বদলাও

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]