আগুনের হলকা আর মৃত্যুকূপে বসবাস

নিমতলীর পর চকবাজার। চকবাজারের পর এফ আর টাওয়ার। এরপর কোথায়?
নিমতলীর পর চকবাজার। চকবাজারের পর এফ আর টাওয়ার। এরপর কোথায়?

কাকলীর পদচারী-সেতু পার হয়ে কামাল আতাতুর্ক সড়ক ধরে পূর্ব দিকে যেতে ডান পাশে এফ আর (ফারুক রূপায়ণ) টাওয়ার। কিন্তু এখানে টাওয়ার বলে আলাদা কোনো ভবন চেনার উপায় নেই। গায়ে গায়ে লাগানো কয়েকটি সুউচ্চ ভবন। বৃহস্পতিবার দুপুরে এফ আর টাওয়ারের আটতলায় আগুন লাগে। আটতলা থেকে সেই আগুন নয়, দশ ও এগারোতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্ক সৃষ্টি হয় আশপাশের ভবনেও।

গতকাল সকালে যখন অগ্নিদগ্ধ এফ আর টাওয়ারের সামনে পৌঁছাই, তখনো লোকজনের প্রচুর ভিড়। অষ্টম ও নবম তলা পুরোটা পুড়ে গেছে। জানালার কাচগুলো পোড়া, ভাঙা। কালো দাগ হয়ে আছে। ভবনের নিচে পাহারায় ছিলেন পুলিশ ও অগ্নিনির্বাপণ দলের সদস্যরা। অগ্নিনির্বাপণ দলের একজন বললেন, অফিসে ফোম ও সিনথেটিকস দ্রব্য থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন ছড়িয়েছিল রাসায়নিক ও প্লাস্টিকসামগ্রী থেকে। ২০১০ সালে নিমতলীতে ১২৪ জন মারা যায়। আর চুড়িহাট্টায় ৭১ জন।

কিন্তু বনানীর ঘটনায় প্রমাণিত হলো নতুন ঢাকাও নিরাপদ নয়। ইমারত নির্মাণ আইন কেউ মানছেন না। বনানীর অগ্নিদগ্ধ ভবনটির মালিক ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করেছেন। আইন প্রতিপালন করানো যাদের দায়িত্ব—সিটি করপোরেশন কিংবা রাজউক কেউ টুঁ–শব্দ করেনি। মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের হুঁশ হলো। গতকাল বনানীর পোড়া ভবনের সামনে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন। দুর্ঘটনার আগে কেউ খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি ভবনগুলো আইন মেনে তৈরি করা হয়েছে কি না। বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। আগুন লাগার পর দেখা গেল এফ আর টাওয়ারের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রও ছিল অচল। ইমারত আইন অনুযায়ী প্রতিটি ভবনের চারপাশে খোলা জায়গা রাখার কথা থাকলেও কামাল আতাতুর্ক সড়কের বেশির ভাগ ভবন একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো। ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই এমন দৃশ্য দেখা যাবে।

রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে সাদা শার্ট ও জিনসের প্যান্ট পরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক উদাস চোখে তাকিয়ে ছিলেন পোড়া ভবনের দিকে। তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলেন, তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম। এফ আর টাওয়ারের ১১ তলায় হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস নামে তাঁদের ব্যবসায়িক অফিস আছে। অফিসে তখন ২৫ জন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন। তার ধরে নিচে নামতে গিয়ে মারা যান ৩ জন। আর আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে ৬ জন। তাঁদের মধ্যে মাকসুদ ও রুমকি নামের এক দম্পতিও আছেন। রুমকি কাজ করতেন অন্য এক অফিসে। স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এফ আর টাওয়ারে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। এই মৃত্যু কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? অষ্টম ও নবম তলায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও কেউ কেউ নামতে গিয়ে মারা গেছেন। কেউবা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।

আমিনুল বললেন, এটি তাঁদের ভাড়া অফিস নয়। ফ্লোর কিনেছেন। ভবনের ত্রুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেনার সময় কাগজপত্রে তো সবই ঠিক ছিল। বাস্তবে যে ঠিক ছিল না তার প্রমাণ মিলল বৃহস্পতিবার দুপুরে।

ভবনের দক্ষিণ পাশে গিয়েও দেখলাম, সেখানেও উৎসুক মানুষের ভিড়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ভেতরে অভিযান শেষ। বাসিন্দাদের ভবনটি বুঝিয়ে দেওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন সেটি ব্যবহারের উপযোগী আছে কি না।

ফিরে আসার পথে দেখি ঘটনাস্থলে এসেছেন পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। মেয়র আগের দিনও এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সিটি করপোরেশন ও রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক অবস্থায় সংস্থাগুলো যে যার মতো কাজ করে। কোনো সমন্বয় নেই। যখন দুর্ঘটনা ঘটে বা দুর্যোগ দেখা দেয়, তখন তারা একত্র হয়। একসঙ্গে বসে, কথা বলে, কমিটি করে। যেমন করেছে
নিমতলী ও চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর। আবারও তারা একত্র হলো বনানীর ২২ তলা ভবনে আগুন লাগার পর।

পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা চকবাজারের আগুন লাগলে অনেকেই সেখানকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু অভিজাত বনানীতেও আমরা একই দৃশ্য দেখলাম। সেই আইন না মানা। সেই ইমারত বিধি ভঙ্গ। সেই অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা না থাকা।

এসব বিষয়ে পূর্তমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, তদন্ত কমিটি করেছেন, কিন্তু আগুন লাগা বন্ধ হবে কি? তিনি বললেন, ‘আগে তদন্ত কমিটি করেই কাজ শেষ হতো। এবার তা হবে না। দোষীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়েই আমরা দায়িত্ব শেষ করব।’ তাঁকে সমর্থন করলেন উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র। বললেন, ঢাকার সব ভবন পরীক্ষা করে যেগুলো আইন ভঙ্গ করেছে, সবটাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

সিরাজুল ইসলাম নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি কামাল আতাতুর্ক সড়কেই একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। বৃহস্পতিবার আগুন লাগার খবর শুনে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন, আগুন থেকে বাঁচতে বেশ কয়েকজন ভবন থেকে লাফ দেন। অনেকে ভবনের পাশে ঝুলে থাকা তার ধরে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। তখন ধারণা করা হয়েছিল, মৃতের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধারকর্মীরা যখন ভেতরে গেলেন, তখনই বের হতে থাকে একের পর এক লাশ।

তাঁর দাবি, অগ্নিনির্বাপণ দল অনেক পরে এসেছে। অন্তত আগুন লাগার আধা ঘণ্টা পর। এসেও তারা সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করতে পারেনি। তবে সেখানে উপস্থিত অগ্নিনির্বাপণ দলের কর্মকর্তা এই অভিযোগ মানতে রাজি নন। আগুন লাগার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা এসে কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু সমস্যা ছিল, ভবনের চারদিকে খোলা জায়গা না থাকায় দুই দিক থেকে অভিযান চালাতে হয়েছে। তা ছাড়া পানির সমস্যা ছিল।

চুড়িহাট্টার আগুনে বেশির ভাগ মারা গেছেন ঘটনাস্থলেই। মুহূর্তে সেই আগুন রূপ নিয়েছিল অগ্নিকুণ্ডে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। কিন্তু বনানীতে দেখা গেল মানুষের বাঁচার কী দুর্মর আকুতি। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে অনেকে নিচে ঝাঁপ দিয়েছেন। অনেকে জানালার কাচ ভেঙে করজোড়ে সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন। আবার অনেকে কোনো কিছু না পেয়ে দেয়ালের পাশে টানানো তার ধরে নামার চেষ্টা করেছেন। কেউ নামতে পেরেছেন। কেউ পারেননি। তার ছিঁড়ে বা হাত ফসকে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

ফিরে আসার সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সীমানা নির্ধারক ফিতার গায়ে লেখা দেখলাম, ‘সচেতন হই, নিরাপদ রই’। একজন ব্যক্তি বা নাগরিক অসচেতন হলে হয়তো তাঁকে একাই ক্ষতিটা ভোগ করতে হয়। কিন্তু দেড় কোটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে যেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের অসচেতনতায় এভাবে একের পর এক ট্র্যাজেডি ঘটতে থাকে। নিমতলীর পর চকবাজার। চকবাজারের পর এফ আর টাওয়ার। এরপর কোথায়?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]