গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ জয়

সিরিয়ার গোলান মালভূমি ইসরায়েলের অবৈধ দখলে এসেছিল আজ থেকে ৫২ বছর আগে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাঝারি উচ্চতাসম্পন্ন প্রায় ১ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মালভূমিটি দখল করে নেয়। ১৯৮১ সালে এটি ইসরায়েলর সঙ্গে একতরফাভাবে সংযুক্ত করা হয় আন্তর্জাতিক নব আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। আর এ বছর মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-উত্তেজনায় বাড়তি এক মাত্রা যোগ হলো।

তবে গোলান মালভূমিকে ট্রাম্পের স্বীকৃতি আসলে তাঁর পক্ষ থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এক উপহার। আগামী ৯ এপ্রিল ইসরায়েলে সাধারণ নির্বাচন। দিনটি যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশের ভেতর দুর্নীতি-অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু ততই মরিয়া হয়ে উঠেছেন নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য। নেতানিয়াহু ও তাঁর দল, তথা লিকুদ পার্টি চরম ডানপন্থী হিসেবে পরিচিতি, যারা উগ্র ইহুদিবাদ, তথা চরম জায়নবাদকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছে। ইসরায়েলের শাসনক্ষমতায় নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য গত কয়েক বছরে লিকুদ পার্টির সরকারে আইনের আবরণে নানা বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছে, ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। বিশেষ করে উচ্চ আদালতকে দুর্বল করা, বাক্‌স্বাধীনতায় আঘাত হানা এবং সংখ্যালঘু আরব জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার হরণ করার মতো বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতেই নেতানিয়াহু থামেননি; ঘুষ-দুর্নীতিতেও তিনি জড়িয়ে পড়েন। এ বিষয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েলি পুলিশ দুটি পৃথক মামলার তদন্ত শেষে জানায় যে নেতানিয়াহুর ‘জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে’ ও ‘বিশ্বাস ভঙ্গ করে’ ‘উৎকোচ-উপঢৌকন’ গ্রহণ করেছেন। আরও অন্তত দুটি মামলা তদন্তাধীন। বিরোধী পক্ষ ও সমালোচকেরা এরপর থেকেই তাঁর পদত্যাগ দাবি করে আসছেন এবং এও বলছেন যে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা হারিয়েছেন, অন্তত নৈতিক বিবেচনায়। নেতানিয়াহু ও তাঁর দল অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশি তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যখন ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেল তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নেতানিয়াহু দফায় দফায় তদবির করে নির্বাচনের আগে তদন্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন এবং কৌশলে চাপ প্রয়োগ করেছেন। এর ফলে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচনের আগে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে না বলে বিবৃতি দিয়েছেন। এতে নেতানিয়াহু শিবিরে বিরাট স্বস্তি এসেছে। আর তারপরই মিসরের কাছে জার্মানির সাবমেরিন বিক্রির বিষয়ে গোপনে ইসরায়েলের অনাপত্তি দেওয়ার বিষয়টি নেতানিয়াহু অ্যাটর্নি জেনারেলকে জানিয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও মেন্ডেলব্লিট তা অস্বীকার করেছেন, তবুও এটা তাঁকে জনসমক্ষে বিব্রত করেছে। অনেকেই এখন মনে করছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল গোপনে নেতানিয়াহুর সঙ্গে সমঝোতা করেছেন।

তবে নেতানিয়াহুকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই। আগামী ১০ জুলাইয়ের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের শুনানি হবে। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে তাঁর। এ রকম অবস্থায় এবারের নির্বাচনের ময়দানে নেতানিয়াহু বেশ বেকায়দায় রয়েছেন। লিকুদ পার্টিও চাপের মধ্যে আছে।

ঘরের চাপ সামলাতে এখন নেতানিয়াহুর তাঁর মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ইসরায়েলের শক্তিমত্তা জাহির করা আর দেশবাসীকে এটা দেখানো যে তিনি ইসরায়েলিদের নিরাপত্তার জন্য কতটা অপরিহার্য। কিছুদিন আগে সিরিয়ার অভ্যন্তরে দফায় দফায় বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের ঘাঁটি গড়ার প্রয়াস থামিয়ে দিয়ে তিনি ইরানকে সরাসরি সংঘর্ষে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। ইরান তাঁর ফাঁদে পা দেয়নি। তবে নেতানিয়াহু দেশবাসীর কাছে দেখাতে চেয়েছেন যে বাড়ির কাছে শত্রুর ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু জানেন যে আট বছরের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাশার আল–আসাদের সিরিয়া এখনো ইসরায়েলের জন্য হুমকি। সিরিয়ার মিত্র হলো ইরান আর লেবাননের হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী। সামরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে থেকেও এই ত্রয়ীজোট ইসরায়েলকে বহু বছর ধরে শঙ্কিত রেখে আসছে। তিনি এও জানেন, সিরিয়ায় ঘাঁটি গড়ার চেষ্টায় ইরান আপাত ক্ষান্ত দিলেও কখনোই পুরোপুরি পিছিয়ে যাবে না। এমতাবস্থায় সরাসরি সংঘাতে না গিয়েও ইরান ও সিরিয়াকে পাল্টা হুমকির মুখে রাখার অন্যতম উপায় হলো গোলান মালভূমি চিরকালের মতো দখলে রাখা। আর নির্বাচনের আগে যদি আমেরিকার কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় করা যায়, তাহলে নির্বাচনের বৈতরণি পার হওয়া অনেকটাই সহজ হবে। সুতরাং, ওয়াশিংটনের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে তিনি শেষ পর্যন্ত সফলও হলেন।

ভৌগোলিকভাবে গোলান মালভূমির অবস্থান হলো সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে, জর্ডানের উত্তরে আর ইসরায়েলের পুবে। দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলে এখানে অন্তত ৩৪টি জনবসতি স্থাপন করেছে এবং ১৬৭টি ব্যবসায়িক স্থাপনা বসিয়েছে। ১৯৬৭ সালে দখলে নেওয়ার পর প্রায় দেড় লাখ সিরীয় এখান থেকে উৎখাত হয়, ৩৪০টি বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এখানকার আদি অধিবাসীদের নিজ বাসভূমে ফিরে আসার অধিকার থাকলেও ফিলিস্তিনিদের মতো তারাও ইসরায়েলি বাধার সম্মুখীন। বর্তমানে গোলানে ২০ হাজার সিরীয় রয়েছে, যারা মূলত দ্রুজ সম্প্রদায়ের। আর বসতি স্থাপনকারী ইহুদির সংখ্যা ২২ হাজার। ইসরায়েলর পরিকল্পনা এক দশকের মধ্যে এই সংখ্যা এক লাখে উন্নীত করা।

গোলান মালভূমি সামরিক কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চতার সুবিধা নিয়ে এখান থেকে সহজেই সিরীয় সীমান্তে নজরদারি করা যায়। আট বছরের সিরীয় যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বাহিনী গোলান থেকেই বাশারবিরোধী পক্ষকে বিশেষত আইএসআইএসকে অস্ত্রসহ মদদ দিয়েছে, আহত আইএসআইএস যোদ্ধাদের এনে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। তবে সামরিক বিবেচনার বাইরেও গোলান খুবই মূল্যবান এর প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে। এখানেই আছে গালিলি হ্রদ, যা কিনা স্বাদু পানির এক বিরাট উৎসাধার। আপেলসহ একাধিক ফলের ভালো চাষ হয় এখানে। মাটির নিচে রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ। ইসরায়েলি ও আমেরিকান বৈদ্যুতিক কোম্পানিগুলো এখানে স্থাপনা গড়ে তুলছে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির জন্য। গোলান পর্যটন ইসরায়েলের জন্য এক ভালো ব্যবসা।

বস্তুত, গোলান সিরিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে কোনোকালেই ইসরায়েলের ছিল না। মিসরকে ১৯৭৭ সালে সিনাই ফেরত দেওয়ার পর একটা ক্ষীণ আশা তৈরি হয়েছিল গোলান নিয়ে। কিন্তু ১৯৮১ সালেই একতরফাভাবে নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে ইসরায়েল বুঝিয়ে দেয় যে সে আশার গুড়েবালি। এ ছাড়া বরাবরের মতো হিব্রু বাইবেল থেকে উদাহরণ টেনেও জায়নবাদীরা দাবি করেছে যে গোলান তাদের কথিত প্রতিশ্রুত ভূমির অংশ। আর এত বছর পর পরম মিত্র আমেরিকার স্বীকৃতিই ইসরায়েলের জন্য যথেষ্ট। সিরিয়াও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে গোলান ফিরিয়ে নিতে পারবে না—এটাও দিবালোকের মতো পরিষ্কার। আরব দেশগুলোও বিবৃতি দিয়ে নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে থেমে যাবে। তা ছাড়া সৌদি আরবের নেতৃত্বে বেশির ভাগ আবর দেশ এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব নিয়ে বেশি চিন্তিত। ইরানকে ঠেকাতে ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত পরোক্ষ মিত্রতার পক্ষে তারা।

তবে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে নির্বাচনী উপহার হিসেবে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা নেতানিয়াহুর নির্বাচনে জয়ী হতে কতটা অর্থবহ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ইসরায়েলিরা এটা জানে, নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী থাকুন আর যে–ই থাকুন, ইসরায়েলি অবৈধ দখলদারি সব সময়ই আমেরিকার সমর্থন পেয়ে আসছে এবং আসবে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে ও সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করেও ট্রাম্প এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি যে তিনি নেতানিয়াহুর কারণে এটা করেছেন। নেতানিয়াহু ও লিকুদ পার্টি যতই এটা তাদের কৃতিত্ব দাবি করুক না কেন, নিজ দেশবাসীর কাছে তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। গোলান মালভূমির অবস্থাটাও অনেকটা সে রকম।

গোলানের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি অবৈধ দখলদারিকেই শুধু সমর্থন দেননি, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল এক দেশ দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রয়াসটিকে তিনি আরও পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী দেশগুলোর বিভিন্ন অবৈধ ও বলপূর্বক দখলদারিকে একধরনের নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব আপাতত ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর বোধের বাইরে।

তথ্যসূত্র: হারেৎস, টাইমস অব ইসরায়েল ও কাউন্টার পাঞ্চ

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
[email protected]