তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা

কাজির গরু শুধু কেতাবে নয়, গোয়ালেও থাকুক।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎপাদনশীল খাত হলো তৈরি পোশাকশিল্প। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাঁকডাক ছাড়াও রপ্তানি বাণিজ্যে বৈচিত্র্যের সন্ধান খুঁজে ফিরছি আমরা বেশ কিছুদিন ধরে। বিভিন্ন বিকল্পের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি প্রায় সবারই পক্ষপাত রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য সরকারের যেসব লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেখানেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় করতে চায় সরকার। ৪০ বছর আগে পরিবর্তনপ্রত্যাশী একঝাঁক তরুণ যেমন করে পোশাকশিল্পের সূচনা করেছিলেন, তেমনি এই অগ্রাধিকার শিল্পেও রয়েছে এ সময়ের তারুণ্যের প্রাবল্য। তাঁদেরই একটি সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সফটওয়্যার অ্যান্ড আইটি এনাবল সার্ভিসেস বা বেসিসের হিসাবে, চলতি বছরে এ খাতে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। তবে ২০২১ সাল নাগাদ ৫০০ কোটির লক্ষ্যমাত্রা যথেষ্ট কঠিনই মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে এ কথা অনস্বীকার্য যে সামান্য কিছু উদ্যোগ এবং সরকারের গা ঝাড়া দেওয়ার মনোভাব এ খাতে আরও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের নগদ প্রণোদনা প্রদান। পোশাক ও অন্য কয়েকটি শিল্পের মতো এই খাতের উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি, রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পূরণ করা হয় ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে। ইতিমধ্যে ২১ মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একজন উদ্যোক্তাও এই ভর্তুকি পাননি। এর কারণও সহজে অনুমেয়। পুরোনো ধ্যানধারণা এবং আমাদের ঐতিহ্য অহংকারের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার কারণেই এই বেহাল অবস্থা। বাজেট পাসের দীর্ঘ আট মাস পর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ে প্রথম পরিপত্রটি প্রকাশ করে। সঙ্গে দেওয়া হয় এই ভর্তুকি দাবি করার বিভিন্ন ফরম, নীতিমালা ইত্যাদি। পোশাকশিল্পের জন্য প্রণীত অনুরূপ ফরম ‘কাট-কপি-পেস্ট’ করে এগুলো বানানো হয়। ফলে এখানে মুখ্য হয়ে ওঠে জাহাজীকরণ, ঋণপত্র, ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র ইত্যাদি। তা ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মূল্য সংযোজনের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করা পণ্য/সেবার হিসাবও চাওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের জ্ঞানভিত্তিক পণ্য বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই নতুন কোনো সফটওয়্যার বা বৈদেশিক সেবার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি এমন অনেক মুক্ত সফটওয়্যার রয়েছে, যেগুলো বিনা মূল্যে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, ইন্টারনেট থেকে শুধু ডাউনলোড করে নিলে হয়।

এই ফরম পড়লেই বোঝা যাবে যে যিনি এটি বানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোনো সংযোগই নেই। এর প্রতিফলন দেখা গেছে এই বিষয়ে গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত একটি সভায়। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, চাহিত ফরমের অধিকাংশ কলামেই তাঁদের ‘প্রযোজ্য নয়’ কথাটি লিখতে হয়। আর এ কারণে সংশ্লিষ্ট অডিট ফার্মগুলো এগুলো ছাড় দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে একই সভাতে সরকারের অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি বলেছেন, ‘প্রযোজ্য নয়’-এর অর্থ হলো অপর্যাপ্ত তথ্য এবং এ কারণে কোনো ভর্তুকির ছাড় হলে পরবর্তী সময়ে অডিট আপত্তি হবে। কাজেই ওই দিন শেষমেশ আলোচ্য ফরম সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধু যে ফরমে ভর্তুকির জন্য আবেদন করতে হবে, সেটি ঠিকঠাক করতে হবে, এটি বোঝার জন্য সংশ্লিষ্টরা ১৯ মাস সময় নষ্ট করেছেন। আর এর মধ্যে আমাদের তরুণ যুবাটি বেসিস-ব্যাংক-অডিট ফার্ম-বাংলাদেশ ব্যাংক ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছেন।

আবার ধরুন ‘ভার্চ্যুয়াল বিজনেস’। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে এমন সব ব্যবসার উদ্ভব হয়েছে, যা আগে কখনো সম্ভব ছিল না। নিজের শয়নকক্ষে ইন্টারনেট সংযোগওয়ালা ল্যাপটপের সাহায্যে এখন অনেক ব্যবসা করা সম্ভব। এমনকি এসব ব্যবসাতে ভোক্তা-উদ্যোক্তার কেউ কাউকে কোনো দিন দেখেনও না। কিন্তু তাতে লক্ষ কোটি টাকার আদান-প্রদান থেমে থাকে না। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে প্রথমবারের মতো এই সব ‘ভার্চ্যুয়াল ব্যবসা’কে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সেগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক কাজটুকু এখনো করা হয়নি। দেশে যেকোনো ব্যবসা করার যে ছাড়পত্র, সেটির নাম ‘ট্রেড লাইসেন্স’ (বিজনেস লাইসেন্স নয়), যার মূল বিষয় হলো পণ্য কোথাও রাখা বা সেবা কোথাও থেকে দেওয়া। দুই ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তার ‘বর্গফুট’ জায়গার প্রয়োজন। কিন্তু যে মেয়েটি ফেসবুকে পেজ খুলে নিজের হাতে বানানো জামা বা খাবার কোনো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেন, তাঁর কেন বাণিজ্যিক এলাকায় কোনো কার্যালয় থাকতে হবে? ১০ হাজারের অধিক এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাঁদের ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারেন, নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যাংক, রকেট-বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা নিতে পারেন, কিন্তু ‘ট্রেড লাইসেন্স’ করতে পারেন না। এ জন্য তাঁকে একটি অফিস ভাড়ার চুক্তি জমা দিয়ে সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে ধরনা দিতে হয়। কেন? আপনি তাঁকে চাকরি দেবেন না, কাজের সুযোগ দেবেন না অথচ তিনি নিজে যদি কিছু করতে চান, তাহলে তাঁকে পদে পদে বাধা দেবেন।

কর্মসংস্থানের কথায় আসি। বিগত দেড় বছরে দেশে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কোন সেক্টরে হয়েছে? আশ্চর্য হলেও সত্যি যে সেটির নাম ‘রাইড শেয়ারিং’। পাঠাও, সহজ, উবার এবং সে রকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই লাখ তরুণের (এমনকি কিছু তরুণীর) সামনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। শুধু যে কর্মসংস্থান হয়েছে তা নয়, একই সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেও এঁরা অবদান রাখছেন। কে ভেবেছে, আপনার বোন বা স্ত্রী অবলীলায় একজন অপরিচিত বাইকারের মোটরসাইকেলের পেছনে বা ড্রাইভারের গাড়িতে করে গন্তব্যে রওনা হবেন? আর এই কর্মসংস্থান সৃষ্টির পুরস্কার হিসেবে আমরা এমন সব নীতিমালা প্রণয়ন করেছি, যা তাদের সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যেমন ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’-এ বলা হয়েছে, কেউ কোনো নতুন গাড়ি বা মোটরসাইকেল কিনলে সেটি এক বছরের আগে রাইড শেয়ারিংয়ে দেওয়া যাবে না। কেন? গাড়ি বা মোটরসাইকেলের বয়সের সঙ্গে সেটির কাজের কী সম্পর্ক? আপনি কি ফ্রিজ কেনার সময় বলে দেন, এক বছরের আগে আপনার ফ্রিজে প্রতিবেশীর মাংস রাখতে পারবেন না? আবার আছেন কোনো গাড়ির মালিক, তাঁর একাধিক গাড়ি এ ধরনের সার্ভিসে দিতে পারবেন না। মানে হলো আপনি আপনার ভাগনে, যিনি কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাঁর পড়ার খরচ জোগাড়ের জন্য তাঁকে আরেকটি গাড়ি কিনে দিতে পারবেন না! বলা হয়েছে, এসব সার্ভিসের ডেটা সার্ভারগুলো দেশে রাখতেই হবে, সেটি আপনার সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক। দেশে কোনো ডেটা প্রোটেকশন আইন নেই, কিন্তু হাঁকডাক তো করতেই হবে। এসব উদ্ভট বিষয় একটি নীতিমালায় লেখা হয় কীভাবে? এমনকি পাঠাও, উবার, সহজ, ওভাই, ওবোন—এ রকম প্রায় ১৬টি কোম্পানিকে এখনো কোনো কাগজপত্রও দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা! ভাবা যায়?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের লাখ লাখ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা এবং উদ্যোক্তাদের পথের বাধা সরিয়ে নেওয়ার কাজটা বিপ্লবী উদ্যমে করতে হবে। মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা ও কাজকর্মের গতি দিয়ে আর যা-ই হোক, একুশ শতকের বাস্তবতা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করা যাবে না।

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক