কেউ ক্ষত চাটি, কেউ চাটি ঘা

এমদাদুল হক
এমদাদুল হক

অপহরণ করেছে তো কী হয়েছে, গুম তো করে নাই। স্বর্ণপদক পেয়েছে তো কী হয়েছে, ছাত্রলীগ তো করে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় যাতে মুখটাও দেখাতে না পারেন, সে জন্য মেধাবী ছাত্র এমদাদুল হককে ‘অপহরণ’ করা হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষাই আসল। সেই পরীক্ষার বদলে দুই দফা মারধরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে তাঁকে। সোনা পুড়িয়ে যেমন খাঁটি করা হয়, তেমনি মারধর করে ছেলেটির ‘চেতনা’ পরীক্ষা করা হয়েছে। ততক্ষণে ভাইবার সময় শেষ, এই আগুনের বাজারে শিক্ষকতার চাকরির প্রায় নিশ্চিত দাবিদার ততক্ষণে ‘বেকার বেচারা’।

এসব বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এখন সেই গল্পের মতো যে ‘এর থেকে আরও খারাপ হতে পারত’। সেই কৌতুকের মতো যে ‘জুতাপেটা করলেও অপমান তো করে নাই’। আসলেই অপহরণ করলেও গুম তো করে নাই। চাকরি না পেলেও জীবনটা তো ফেরত দিয়েছে। পুলিশ বা উপাচার্যের কাছে না গিয়ে এমদাদুলের তাই শোকর গুজরান করা উচিত। আর পারলে বিভাগের ইতিহাসের সেরা ফলের স্বর্ণপদকটা লুকিয়ে বা বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। তাঁর মতো ভালো ছাত্রের জন্য সে দরজা খোলাই থাকার কথা। এভাবে আমরা আমাদের সেরা প্রতিভা ও যোগ্যতা অপহরণ করে, বিতাড়িত করে করে উন্নতির সপ্তম সোপানে পা রাখব নির্ঘাত!

আমরা সব পারি। বিয়ের দিন কনেকে অপহরণ করা, নির্বাচনের দিন ব্যালট পেপার–বাক্স মায় আস্ত ভোটকেন্দ্র লোপাট করা, প্রার্থীকে অপহরণ বা গুম করা, টেন্ডারের দিন টেন্ডার বাক্স কেড়ে নেওয়া কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকাদারকেও নাই করে দেওয়া আমাদের ধাত। যে পা মিছিল করে তা ভেঙে দেওয়া, যে মেরুদণ্ড সটান দাঁড়ায় তাকে হাতুড়িপেটা করে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যে জবান সত্য বলে তার টুঁটি চেপে ধরায় আমরা সিদ্ধহস্ত। মানে হস্ত যাতে সিদ্ধ বা পাকা হয়েছে। এতই পাকা যে এমদাদুলের অপহরণকারীরা তা গর্বের সঙ্গে স্বীকারও করেছেন।

সোমবারের প্রথম আলোয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিলুপ্ত কমিটির সহসম্পাদক শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘এমদাদুল শিবিরের নেতা ছিলেন’। ব্যস, যার সঙ্গে মেধায়–যোগ্যতায় পারবে না তাকে বদনাম দাও। তাহলে সব কিছু মাফ। এই হলো জর্জ বুশীয় যুক্তি: ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে তাই দেশটাকে আরও ভয়াবহ গণবিধ্বংসী অস্ত্রে ধ্বংস করে দাও। ধ্বংসের পরে দেখা গেল সব রটনা, বদনাম। এমদাদুল প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যে অধ্যাপকের গবেষণা সহকারী ছিলেন, তিনি কিন্তু স্পষ্টভাবেই বলেছেন এমদাদুল হক ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তাহলে? তাহলে, বাঘই যদি না থাকে তাহলে ঝোপ নড়ল কেন? ঝোপ নড়লেই যার বাঘের ভয় মাথায় আসে, তার সমস্যাটা ঝোপেও না চোখেও না, মাথাতেই। যাদের মগজে এত ভয়, তাদের হাত হয়ে যায় হাতুড়ি, চাপা হয়ে যায় চাপাতি।

এদের বদৌলতে উপাচার্যেরা কী হয়ে যান তা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চপ, সমুচা, শিঙাড়ার গুণাগুণে দেখেছিলাম, এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বরাতেও জানলাম। অপহরণ ও নির্যাতনের কারণে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় হাজির হতে না পারা এমদাদুল উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিস্তারিত সবই বলেছেন। কিন্তু উপাচার্য সাহেব নাকি রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাননি। তাঁর দপ্তর যদি এভাবেই চলে, জমা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ যদি তাঁর কাছে না পৌঁছায়, তাহলে তো নিজ দপ্তরের কার্যকারিতা নিয়ে টনক যদি থাকে সেটাই তাঁর নড়ানো উচিত।

অবশ্য অভিযোগ পেলেও তিনি কিছুই করতেন না। তিনি স্পষ্টভাবে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘পুনরায় শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব নয়’। অর্থাৎ এমদাদুলের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তা তিনি স্বীকার করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রের অভিভাবক ও প্রশাসক হিসেবে নিজের কর্তব্য পালনে তাঁর কোনো গরজ নেই। গরজটা কি তাহলে সন্ত্রাসীদের রক্ষায়, যোগ্যতমকে শিক্ষক হিসেবে দেখতে না চাওয়ায়?

অপহরণ আসলে একা এমদাদুল হয়নি। হয়েছে আইন, হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও সত্য, অপহরণ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একটা খুঁটি। এভাবে কড়ি–বরগা, ভিতের ইট–পাথর অপহৃত হয়ে হয়ে সব কিছু নাঙা হয়ে গেলেও তাঁরা মানবেন না। বুঝবেন না যে সবকিছু ভেঙে পড়ার মুখে। এমদাদুলের বঞ্চনা ও নির্যাতনের চেয়েও বড় এই ভয়, যাঁরা দায়িত্বে তাঁরা বুঝতেই পারছেন না, সবার ও নিজেদেরও কত বড় ক্ষতি তাঁরা করছেন। কোনো কোনো প্রাণী নিজের ক্ষত–ঘা লেহন করে। আমরা বোধ হয় আমাদের অন্যায় ও মিথ্যাকে লেহন করার জায়গায় চলে এসেছি। আর যারা ভুক্তভোগী, তারা উপায় না পেয়ে নিজ নিজ ক্ষত চেটে উপশমের চেষ্টা করছি।

শিবির পরাস্ত শক্তি। ছাত্রসমাজের কাছে তারা জনপ্রিয় হওয়ার বদলে ভীতিই অর্জন করেছে বেশি। শিবির খেদাতে খেদাতে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কেউ কেউ বা অনেকে যদি তাদেরই মতো হয়ে যায়, এর থেকে কঠিন পরিহাস আর কী হতে পারে? প্রতিপক্ষকে মুখ ভেংচাতে ভেংচাতে নিজের মুখটা যদি প্রতিপক্ষের ভেংচি কাটা মুখের আদল পেয়ে গেলে জয় হয় আসলে কার?

চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইটস ছবিতে একটা অসাধারণ পরিস্থিতি আছে। এক লোক খেলতে খেলতে একটা ছোট হুইসেল বাঁশি গিলে ফেলেন এবং একের পর এক হিক্কার শিকার হন। বাঁশিটি তাঁর গলার ভেতর আটকে থাকা অবস্থায় হিক্কার দমক শুরু হলে বাঁশির দরজায় বাতাস লাগে। আর গলার ভেতর সেটা বেজে ওঠে। এ রকম হাস্যকর অবস্থায় লোকটা যতবার হিক্কা দেন, ততবার তাঁর পেটের ভেতর থেকে অদ্ভুত এক হুইসেল বেজে উঠতে থাকে। বিব্রত বেচারা মরিয়া হয়ে শব্দটি লুকাতে যান, কিন্তু খুঁজে পান না কী করবেন। তিনি বোঝাতে যান যে যেটা বাজছে সেটা তাঁর শরীরের অংশ না, ওটা বহিরাগত জিনিস। কিন্তু তখন তো জিনিসটা আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে শ্বাস নিলেই বাঁশিটা বাজছে। এদিকে শ্বাস না নিয়েও তো থাকা যাচ্ছে না।

অন্যায়–হিংসা–লোভ যতক্ষণ বাইরে থাকে, সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা শরীর–মনের অংশ হয়ে গেলে তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অবস্থা যে পর্যায়ে গেছে তাতে এসব থামাতে গেলেও বিপদ আবার না থামালে বিপদের বাঁশি নিয়মিতভাবে বেজেই চলবে!

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
[email protected]