৮ শতাংশ হার পেরোনো প্রবৃদ্ধি

দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছর ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থবছরের ৯ মাস শেষ না হতেই প্রাথমিক হিসাব থেকে এ তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন হলো ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হতে যাচ্ছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। মানে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তথা অর্থনীতির আয়তন এই হারে বড় হয়েছে। অন্যভাবে বললে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে, ৮ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি তা–ই নির্দেশ করে।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার এখন পৌনে ৭ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রথম প্রবৃদ্ধির হার ‘৬ শতাংশের চক্র’ ভেঙে বের হয়ে আসে। সে বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। পরের দুই বছর তা আরও বাড়ে আর চতুর্থ বছরে গিয়ে ৮ শতাংশের ওপরে উঠে আসে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বিবিএসের প্রাথমিক প্রাক্কলন দেখাচ্ছে যে বাস্তবে প্রবৃদ্ধির হার তার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যায়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শুরুর বছর (২০১৫-১৬) থেকেই প্রকৃত প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপিত হারের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আগের ছয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কখনোই এ রকম হয়নি। বরং সব সময়ই প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার পরিকল্পনা দলিলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে।
৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন ক্ষমতাসীন ও নীতিনির্ধারকদের জন্য স্বভাবতই বেশ উচ্ছ্বাসের বিষয়। দেশের মানুষের কাছেও তা আনন্দদায়ক একটি অর্জন। তবে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে একটু সতর্কতার প্রয়োজন আছে, আছে একটু খতিয়ে দেখার বিষয়।
৮ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির হারের অঙ্কটি এখন প্রাথমিক প্রাক্কলন। পরিসংখ্যান ব্যুরো কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাত মাসের প্রকৃত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশের প্রাথমিক অঙ্কটি দাঁড় করিয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে যে এত অল্প সময়ের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে পুরো বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যমান নির্ণয় করা কতটা যুক্তিযুক্ত? যেমন, বিবিএস এখন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) বড় ও মাঝারি শিল্প উৎপাদনসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অবশ্য আট মাসের রপ্তানি ও সাত মাসের আমদানির পরিসংখ্যান মিলেছে। এগুলোসহ আরও কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে এ বছর সার্বিক শিল্প উৎপাদনে ১৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আবার কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছর কমে গিয়ে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। তার মানে হলো কৃষি উৎপাদন বাড়লেও আগের বছরের তুলনায় কম হারে বাড়ছে। কৃষিতে একটি বড় অংশ হলো বোরো ধানের উৎপাদন। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধানের আবাদ হয় আর ফলনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র জুন মাস নাগাদ পাওয়া যায়। সুতরাং, বিবিএসকে এখন বোরোর আনুমানিক উৎপাদন ধরে নিয়ে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করতে হয়েছে বলে মনে করা যায়। বর্তমানে দেশে চালের ৫৫ শতাংশ বোরো আবাদ ও ৩৮ শতাংশ আমন আবাদ থেকে আসে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক প্রাক্কলনটি অনেকাংশেই বিভিন্ন সূচকের সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতির অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর তাই প্রাথমিক প্রাক্কলন যত উৎসাহজনক চিত্র দেখাক না কেন, তা নিয়ে বাড়তি কিছু খটকা থেকেই যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মদক্ষতা যে বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরো বছরের হিসাব সাত-আট মাসের চিত্র থেকে পূর্বানুমান করা খুব সহজসাধ্য নয়। অন্তত ৯ মাসের বা তিন-চতুর্থাংশ সময়ের অগ্রগতির হিসাব-নিকাশ হাতে নিয়ে প্রাক্কলন বোধ হয় অধিকতর নির্ভরযোগ্য। একটা সময়ে মে মাসের আগে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যেত না। গত তিন-চার বছরে এই সময়টা ক্রমে এগিয়ে এসেছে। আবার এটাও ঠিক যে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকে হালনাগাদ চিত্র আসবে, প্রাক্কলনটি সংশোধিত হবে। আর চূড়ান্ত হিসাব পেতে এখন থেকে আরও মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে কমবেশি কিছু বিতর্ক থাকবে।
প্রবৃদ্ধি বিতর্কে বহুমাত্রিকতার একটা ভালো দৃষ্টান্ত হলো ভারত। কিছুদিন আগে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন ও নির্ণয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী। তবে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন এবং পাল্টা একহাত নিয়েছেন। তাতে থামেননি ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়রা’। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন বরং তা বাড়িয়েছেন কর্মসংস্থান, তথা চাকরির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি নিয়ে তর্কটা ওরকম জোরালো নয়। তবে এখানে এখন তর্ক বা সমালোচনায় প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে গুণগত দিকটা ক্রমে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাস্তবে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, নাকি হয়নি—এ প্রশ্ন এখন আর সেভাবে উত্থাপিত হবে না। কেননা, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে অব্যাহত সরকারি বিনিয়োগ, শিল্প ও ব্যবসায় নানামুখী বৈচিত্র্য এবং মানুষের ব্যয় করার প্রবণতাগুলো লক্ষ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে অর্থনীতির আয়তন বেড়ে চলেছে। তবে ক্রমে বড় হওয়া অর্থনীতি থেকে যে সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার ভাগ–বাঁটোয়ারাটা কীভাবে হচ্ছে, কতটা সুষমভাবে হচ্ছে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাটাও এখন বাড়ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির এই সময়ে এগুলো অবশ্য বিব্রতকর প্রশ্ন, বিরক্তিকরও হয়তো!

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক
[email protected]