শিক্ষা দশক ঘোষণা করা হোক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দুটি ভাষণে তাঁর শিশুবান্ধব মনের পরিচয় তুলে ধরেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকে ভর্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়া এবং শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। আর প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য জানেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সফলভাবে কাজে রূপায়িত করতে হলে যথেষ্ট প্রস্তুতির ও আগাম কিছু কাজের প্রয়োজন হয়। আশার কথা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দায়িত্ব দিয়েছে। তা সত্ত্বেও বলব প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান বাস্তবতায় এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে না।

ভর্তি পরীক্ষা তুলে দেওয়াও কি সহজ হবে? প্রথমত, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা তো শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষার মাধ্যম ও শিক্ষার মানে এক নয়। সংবিধান ও শিক্ষানীতির নির্দেশনা এবং শিক্ষা সম্পর্কে সর্বজনীন ধারণাকে উপেক্ষা করে শিক্ষা বহুধারায় তো চলছেই, সঙ্গে রয়েছে মানের চরম অসাম্য। এর ফলে অভিভাবকদের জন্যই বাড়ির কাছের বিদ্যালয়টি প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ সাধারণত থাকে না। তাতে স্কুলে স্কুলে ছাত্রসংকট বা ভর্তিসংকটের দুই বিপরীত চিত্র দেখা যায়—কোথাও আসন পূরণ হয় না, কোথাও উপচে পড়া ভিড়। ভর্তি পরীক্ষা ভর্তি-ইচ্ছুকের ভিড় সামলাতে সাহায্য করার পাশাপাশি স্কুল সম্পর্কে সমীহ জাগায়, যত কঠিন ভর্তি পরীক্ষা, অভিভাবকদের ভক্তি যেন ততই বাড়ে। এটি হয়তো শিক্ষা-বিপণনের একটি কার্যকর কৌশলও বটে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো সন্তানদের (ছাত্রদের) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি। মাধ্যমিকের সূচনা-শ্রেণিটি নির্দিষ্ট নয়, বিদ্যালয়ভেদে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম আর ক্যাডেট কলেজ শুরু হয় সপ্তম শ্রেণি থেকে। সন্তানদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করতে অনেক অভিভাবক তৃতীয়–চতুর্থ শ্রেণি থেকে কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিদ্যালয়কে উপেক্ষা করে কোচিংকেই গুরুত্ব দেন। ভর্তি পরীক্ষা যেহেতু বাংলা-ইংরেজি-গণিতের ভিত্তিতে হয়, তাই এ সময় শিক্ষার্থীরা মা-বাবার ইচ্ছায় অন্য বিষয় পড়ে না। কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দিতে দিতে তারা পরীক্ষায় পাকা হয়ে ওঠে। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা তার পরবর্তী ধাপের ব্যবস্থা বা অব্যবস্থার দায় নিতে বাধ্য হচ্ছে।

বইয়ের বোঝা বেড়েছে, এ কথা সত্য। এর একটি বড় কারণ পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এতে একদিকে যেমন বই ও পড়ার চাপ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বয়সের চেয়ে উচ্চতর বিষয় মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষককে চমকে দিয়ে বেশি নম্বর আদায়ের কৌশল। প্রাথমিকে বই বেশি প্রয়োজন হয় না, যদি শিক্ষক পাঠদানে একটু সৃজনশীল হন আর ছাত্রদের জন্য নিজেরাই ওয়ার্কশিট বা অনুশীলনপত্র তৈরি করে নেন। কিন্তু এই সঙ্গে বলব, পরীক্ষাকেন্দ্রিক মুখস্থনির্ভর শিক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী পঠনপাঠন কমই হয়। একবার পড়তে শিখলে তার তো সে বিদ্যা প্রয়োগ করার ইচ্ছা হবে প্রবল। সে জন্য বিচিত্র স্বাদের বইয়ের সরবরাহ দরকার, প্রয়োজন শ্রেণিকক্ষে দলে মিলে আনন্দদায়ক সৃজনশীল সাহিত্য পাঠ ও শোনার ব্যবস্থা, আবৃত্তি শোনা-শেখা ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের আয়োজনই-বা কোথায়। আমাদের সব স্তরের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপে থাকে, অথচ গোটা শিক্ষাজীবনে তাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করার মতো পাঠের অবকাশ মেলে না। অবশ্যই এ পদ্ধতির অবসান হওয়া দরকার।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ করতে হলে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ সক্রিয়তা ও অনুশীলনের সম্পর্ক তৈরি হতে হবে। এর জন্য দুটি প্রয়োজনীয় বিষয় হলো ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কিছুতেই ১: ৩০-এর বেশি হতে না দেওয়া এবং শিক্ষকের চাই দক্ষতা, সততা, সৃজনশীলতা এবং শিশুর জন্য ভালোবাসা, যা তাদের পরিশ্রমের প্রেরণা জোগাবে। বহুদিনের অব্যবস্থায় এসব ক্ষেত্রে যে বিপুল ঘাটতি আছে, তা আমরা সবাই জানি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো শিশুশিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করি, তাদের ভীষণভাবে আশান্বিত করেছে। শুধু বলব, বাস্তবতা অনুধাবন করে এবং লক্ষ্য ঠিক করে কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজাতে হবে। আমাদের দেশে শিশুর সংখ্যা অনেক—সব ধারা মিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি। তা ছাড়া সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার অভাবে অব্যবস্থাও চরম। তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটু সময় লাগবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলে সমস্যা হয়তো ভিন্ন রূপেই দেখা দেবে, যা অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে।

শিক্ষার মানোন্নয়নের যে দায় এসডিজিতে রয়েছে, তারই অ্যাজেন্ডা হিসেবে এ কাজটাকে গণ্য করা উচিত। তা ছাড়া যেহেতু দেশে শিক্ষার সব স্তরেই মানের সংকট রয়েছে, তাই এ কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বুঝেই বড় পরিকল্পনা নিতে হবে। আমি বলব, আগামী এক দশককে শিক্ষা দশক ঘোষণা করা হোক। এর প্রথম পাঁচ বছর ব্যয়িত হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। শিক্ষানীতি, যা সরকার গ্রহণ করেছে, তার ভিত্তিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এ স্তর প্রসারিত করে মানোন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়নের বিচারে এটি পদ্মা সেতুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং তাই এ কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মানসম্পন্ন সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এক ধাক্কায় জাতি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তখন আমরা উন্নত মানবসম্পদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। এর জন্য প্রয়োজন হবে সারা দেশের বর্তমান স্কুলগুলোর সক্ষমতা ও ঘাটতি নিরূপণ এবং তার ভিত্তিতে সেগুলোর উন্নয়ন, নতুন স্কুল স্থাপন, নতুন শিক্ষক নিয়োগদান ইত্যাদি। প্রতিটি স্কুলে পাঠাগার থাকা জরুরি। স্বল্প মূল্যে হাতে-কলমে বিজ্ঞানচর্চার সরঞ্জাম রাখাও সম্ভব।

মাঠ থেকে এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষা দশকের প্রথম পাঁচ বছর প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অবশ্যই বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে, যাতে কোনো কাজ ঠেকে না যায়।

তবে ভবন, পাঠাগার, ল্যাব, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, পরীক্ষা ও বইয়ের বোঝা থেকে মুক্তি ইত্যাদি কোনো কিছুই উচ্চ মানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এর জন্য নিশ্চিত করতে হবে উপযুক্ত শিক্ষক। আমাদের সমাজে স্কুলশিক্ষকতা পদ এবং জীবিকা হিসেবে যথোচিত মর্যাদা পায়নি। বরং দিনে দিনে এ কাজ আকর্ষণ ও মর্যাদা দুই-ই হারিয়েছে। এর মূল কারণ বেতন-ভাতা এবং পদের অবস্থান। উপযুক্ত বেতনসহ এটি একটি স্বতন্ত্র সম্মানজনক ক্যাডার হলে মেধাবী ছাত্ররা ধীরে ধীরে এ পেশায় আসবেন। গুণগত পরিবর্তনের জন্য মেধাবী, সৃজনশীল ও শিশুবান্ধব তরুণ-তরুণীদের এ কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। প্রধান শিক্ষক নিয়েও ভাবতে হবে। কেননা, তিনিই হলেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতা এবং শিক্ষকদের দার্শনিক ও বন্ধু। শিক্ষকদের জন্য বাছাই করা ১০০টি বইয়ের তালিকা থাকবে এবং প্রতিবছর এ থেকে অন্তত ১০টি বই নিয়ে নিয়মিত পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হবে। কাজটি কীভাবে সফল হবে, তার নির্দেশনা থাকবে। শিক্ষকদের পাঠের জন্য একটি সুপরিকল্পিত পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হলে জ্ঞানে ও শিক্ষকতার নানা বিষয়ে তাঁরা হালনাগাদ থাকতে পারবেন এবং এ পেশা নিয়ে গর্ব অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত থাকবেন।

শিশুশিক্ষায় আমাদের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে শিক্ষক দল গঠন, যোগ্য নেতৃত্ব, নিয়মিত পাঠপরিকল্পনা ও উপকরণের ব্যবহার, সহপাঠ কার্যক্রমসহ আনন্দময় পরিবেশ স্কুলের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করে। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন হলো অনুপ্রাণিত উদ্যমী শিক্ষক দল এবং যোগ্য নেতৃত্ব। এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তাঁরাই স্কুলের সাফল্যের জন্য যা করণীয়, তা করবেন। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়ন ওপরের নির্দেশে ঘটবে না, ঘটবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে, শিক্ষকদের ভূমিকায়।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক