কাদের গরু মরে?

গরু। ফাইল ছবি
গরু। ফাইল ছবি

উত্তরের অভাগাদের গরু মরছে শয়ে শয়ে। সরকারি–বেসরকারি প্রাণী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব নেই, তারপরও বাঁচানো যাচ্ছে না গরিবের

ধন। বাজারের ওষুধে কাজ করছে না। সেই কারণে বোধ হয় বলা হচ্ছে ‘অজানা রোগ’। রোগ অজানা হলে তার তত্ত্বতালাশ হালসাকিন নির্ধারণের দপ্তর আছে, গবেষণাগার আছে। তবু জানা যাচ্ছে না ‘কেইস’টা কী? ঈদ সামনে রেখে যাঁরা গরু–ছাগল পালনের জন্য ঋণ নিয়ে অল্প পুঁজির কাজ শুরু করেছিলেন, সেসব ক্ষুদ্র খামারি আর গৃহস্থ চাষি পড়েছেন বিপাকে।

উত্তরের জনপদ নাগেশ্বরীতে গত এক সপ্তাহে অজানা রোগে প্রায় ১০০টি গরু মারা গেছে। সুস্থ–সবল গরু হঠাৎই কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মিনিট কয়েকের মধ্যে মারা যাচ্ছে। প্রাণী চিকিৎসকেরা নানা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে এক রকম অনুমাননির্ভর চিকিৎসা দিয়ে চেষ্টা করলেও জলজ্যান্ত গবাদি প্রাণীর আচানক মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। স্থানীয় প্রাণী চিকিৎসক ছানোয়ার হোসেন সংবাদকর্মীদের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত বল্লভেরখাস ইউনিয়নের মহসিনের চরে ৪৩টি, রঘুরভিটায় ১৩টি, দেওয়ানগাজীতে ১টি, কেদার ইউনিয়নের ছালামের চরে ২টি গরু মারা গেছে। কথিত রোগটি কিন্তু ছয়–সাত মাস ধরেই কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের নানা জনপদে আতঙ্কজনকভাবে প্রাণিসম্পদের ক্ষতিসাধন করে চলেছে।

নাগেশ্বরীতে মার্চের (২০১৯) দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মহামারির আকার নিলেও ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কুড়িগ্রাম ও তার আশপাশের জেলার নানা উপজেলায় খামারি আর চাষিদের আতঙ্কে কোণঠাসা করে রেখেছে এই কথিত অজানা রোগ।

গত বছরের ডিসেম্বরে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় গবাদিপশুর মধ্যে কথিত অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতে থাকে। উপজেলার উমর মজিদ ও চাকিরপশার ইউনিয়নে সে সময় দুই সপ্তাহের মধ্যে ৫০–৬০টি গরু–ছাগল একযোগে হঠাৎ আক্রান্ত হলে গ্রামবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। কয়েক দিনের ব্যবধানে আক্রান্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে ১৫টি গরুর মৃত্যু হলে পরিস্থিতি সংকটে রূপ নেয়। দিনমজুর জাহাঙ্গীরের (গ্রাম তেলিপাড়া) শেষ সম্বল তিনটি গরু রোগে আক্রান্ত হলে তিনি দ্রুত কসাই ডেকে সেগুলো বিক্রি করেন। অনেক কষ্টে প্রায় পানির দরে একটি গরু কসাই নিতে রাজি হলেও গাভিন গাভি আর বাছুর বিক্রি হয় না। এগুলো বাড়িতেই মারা যায়। শেষ হয়ে যায় জাহাঙ্গীরের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন।

গরুগুলো যাতে রোগবালাইমুক্ত থাকে, সেই জন্য জাহাঙ্গীর মাসখানেক আগে সব কটি গরুর জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেও রেহাই পাননি। তাঁর কথা, ‘ডাক্তার কী ভ্যাকসিন দিল কে জানে। আমি গরিব মানুষ, এই ক্ষতি কেমন করে পোষাব।’ উমর মজিদ ইউনিয়নের আরেক দিনমজুর মাইদুল ইসলামের ২টি গরু সে সময় মারা গেলে তিনি তাঁর অবশিষ্ট আক্রান্ত গরুটি মাত্র ১২ হাজার টাকায় কসাইয়ের কাছে বিক্রি করেন। অন্য সময় হলে গরুটি ২৫–২৬ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।

জাহাঙ্গীর, মাইদুলের মতো অনেকে আক্রান্ত প্রাণী কসাই বা মাংস বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে সংকট কাটানোর চেষ্টা করেন। নিরুপায় আর ঋণগ্রস্ত মানুষের এ রকম উদ্যোগ অনেক সময় জনস্বাস্থ্যকে হুমকির সম্মুখীন করতে পারে। এ দেশে মানবদেহে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ আক্রান্ত গরুর মাংসের মাধ্যমেই ছড়িয়েছিল।

কুড়িগ্রাম জেলার মধ্যে নদীভাঙনের অভিশাপমুক্ত অপেক্ষাকৃত বর্ধিষ্ণু উপজেলা রাজারহাটের সাতটি ইউনিয়নে প্রায় ২০০ দুগ্ধজাত গরুর খামার আছে। আছে ৫০টির মতো ছাগল ও ভেড়ার খামার। তবে কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ায় এবং উপজেলায় পর্যাপ্ত চারণভূমি থাকায় উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পাঁচ–সাতটি করে গরু রয়েছে। এখানে অন্তত আশা করা গিয়েছিল, প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে। সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে উমর মজিদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরদারের মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তিনি নিজে জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করেন। তবে রোগ নিরাময় কিংবা প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ তিনি দেখতে পাননি। এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জোবায়দুল কবির সেই সময় পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করেছিলেন। বলেছিলেন, গ্রামের লোকেরা আক্রান্ত পশুর নানা অপচিকিৎসা করার কারণে অনেক সময় পশুর মৃত্যু হয়।

এবার নাগেশ্বরীতে রোগ বিস্তারের খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। গবাদিপশু বাঁচাতে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা। তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে জানাচ্ছেন, আপাতত গবাদিপশুকে খামারিরা গোচারণভূমির নতুন গজিয়ে ওঠা ঘাস যেন না খাওয়ান।

বাংলাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন রোগব্যাধিতে ২০ শতাংশ গবাদিপশু মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এসব রোগ প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। শুধু কার্যকরী টিকার অভাবে বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রাণিসম্পদ নষ্ট হচ্ছে।

অন্যদিকে আমদানি করা কিংবা পাচার হয়ে আসা ভ্যাকসিনের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য মানসম্মত ল্যাব কি আমাদের আছে? এ ছাড়া এসব ভ্যাকসিন যে তাপমাত্রায় রাখা দরকার, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো মানে না। ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে পড়ে আর জাহাঙ্গীরদের বলতে হয়, ‘ডাক্তার যে কী ওষুধ দিল।’

আশার কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্ব ১৭ সদস্যের একটি গবেষক দল ছয় বছরের বেশি সময় নিয়ে ২০১৮ সালে গরুর প্রধান মরণব্যাধি খুরারোগের টিকা আবিষ্কার করে। অধ্যাপক আনোয়ার জানালেন, এর আগেও বাংলাদেশে টিকা তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু সেটা গবাদিপশুর এই রোগ সারাতে তেমন কার্যকরী নয়। আবিষ্কৃত নতুন এই টিকা উৎপাদনের জন্য ইতিমধ্যে পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হয়েছে।

সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে, যেসব ভাইরাসের কারণে এই রোগ হয়, তার প্রতিটি ভাইরাস এখন চিহ্নিত হয়েছে। এমনকি প্রতিটির জীবনবৃত্তান্ত তাঁরা বের করেছেন। আশা করা হচ্ছে, এখন যে দামে খামারিরা ওষুধ কিনছেন, তার চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে তাঁরা কিনতে পারবেন নতুন এই ওষুধ। ধাপে ধাপে এর দাম আরও কমানো সম্ভব হবে বলে অধ্যাপক আনোয়ার মনে করেন। তবে বাজারজাতকরণ বা খামারিদের কাছে এই টিকা পৌঁছাতে এখনো দেড় বছর সময় লাগবে।

আমরা আশা করি, সব বাধা অতিক্রম করে এই গবেষণার ফল দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে আর প্রাণিসম্পদ রক্ষায় আমাদের প্রচেষ্টা আর ধারাবাহিক গবেষণা অব্যাহত থাকবে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

nayeem 5508 @gmail.com