সব কমিশনারের দায় সমান

একজন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চার দফায় ভোট গ্রহণ শেষে তিনি নির্বাচন ভবনে গণমাধ্যমকে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, জাতি এক গভীর খাদের দিকে অগ্রসরমাণ। তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নামান্তর। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখা প্রয়োজন।’ তিনি মনে করেন, গত দুই বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে কমিশনের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেছেন, ‘অনেকের মতে নির্বাচন কমিশন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন জাগে, কত দূর যাওয়ার পর এ ঘুরে দাঁড়াবার বোধোদয় ঘটল? উপজেলা নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্র বন্ধ করা এবং অনিয়মের জন্য পুলিশ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের সময়ে এহেন তৎপরতা দেখা যায়নি কেন? এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজলে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রকৃত স্বরূপটি উদ্‌ঘাটিত হবে।’ সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে ইসির হাতে ন্যস্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এই কমিশনার। তিনি মনে করেন, রিমোট কন্ট্রোলে নির্বাচন কন্ট্রোল করা হলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে, যা গণতন্ত্রের জন্য অনভিপ্রেত। সাংসদদের আওতা থেকে উপজেলা পরিষদকে মুক্ত করা না হলে উপজেলা নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।

নির্বাচন কমিশনারের এসব বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনার দাবি রাখে। পাঁচ সদস্যের কমিশনে তিনি একজন কমিশনার। প্রথমেই দেখা দরকার, তিনি এসব প্রশ্ন কার বা কাদের কাছে করলেন? আর সাংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। এ ক্ষমতা প্রয়োগে অক্ষমতা বা অযাচিত শৈথিল্য তাদের ওপরই বর্তাবে। আর নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থায় যেকোনো বিবেচনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রয়োজন হবে। তাঁদের আইনি নিয়ন্ত্রণও কমিশনের কাছেই সে সময়ে থাকে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আইনি ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়।

সাংসদদের আওতা থেকে উপজেলা পরিষদকে মুক্ত করার যে দাবি নির্বাচন কমিশনার করলেন, তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকারগুলোকে আইনি কাঠামো অনুযায়ী তাদের মতোই চলতে দেওয়া সংগত। তবে তা করা হলেও স্থানীয় পর্যায়ের শাসনব্যবস্থায় সাংসদদের যে সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ, তা কি কমবে? অবস্থাটি যেকোনো নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থায় তাঁদের প্রভাবমুক্ত করা একরূপ অসম্ভব করে তুলেছে। তবে কথা থাকে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশন তো বেশ কিছু সাংসদকে সতর্ক করেছে, নোটিশ দিয়েছে এলাকার বাইরে যেতে। কমিশনারের নির্দেশে প্রত্যাহার করা হয়েছে পুলিশসহ বেশ কিছু নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগে স্থগিত করা হয়েছে কোনো কোনো উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্য ঠিক যে এ ধরনের তেমন কিছুই করা হয়নি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে।

সেই নির্বাচনগুলো সব দলের অংশগ্রহণমূলক ছিল। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা চালানোর সময়েই সরকারি দলের কর্মী-সমর্থক, এমনকি তাদের পক্ষ নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিরোধী দলকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেয়নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনার উল্লেখ না করলেও নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়টি নির্বাচনের অংশই বটে। এখানে যথাযথ প্রচার-প্রচারণার সুযোগ না পেলে, প্রার্থীদের এজেন্টদের টিকতে না দিলে আর তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িছাড়া করলে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব পড়বেই।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলসহ অনেক দল বর্জন করায় সরকারি দল ও তাদের সহযোগী দু-একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। শতাধিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নিজ দলের মধ্যে। কোথাও তীব্র আর কোথাও-বা নামমাত্র। সে ক্ষেত্রে ভোটারের কম উপস্থিতি অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে এটা কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এবং আইনগত কোনো বিপত্তিও নেই। তবে নির্বাচনকে অর্থবহ করার মূল দায়িত্ব তাদেরই। অবশ্য সরকারসহ সব দল-মতের সমর্থন দরকার।

একজন নির্বাচন কমিশনার যে বক্তব্যগুলো গণমাধ্যমে দিলেন, তা আমাদের চলমান নির্বাচন ব্যবস্থার একটি বিপর্যয়কর দিক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কথা থাকবে, এ বিপর্যয় ঠেকানোর দায়িত্ব যাঁদের, তিনি তো তাঁদেরই একজন। তিনি কি বিভিন্ন সময়ে কমিশনের সভায় এসব কথা জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন? সেগুলো কি কমিশনের কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ আছে? তা থাকলে তথ্য অধিকার আইন বলে এর অনুলিপি গণমাধ্যম পেতে পারে। শুধু সংখ্যাধিক্যের জোরে তাঁর ন্যায়সংগত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হলে তিনি তো প্রতিবাদী হতে পারতেন। কোনো ক্ষেত্রে তো পদত্যাগও করেন কেউ কেউ। অথচ এ সাংবিধানিক সংস্থাটির অতি উঁচু মর্যাদা ও প্রভূত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন পদটিতে তিনি রয়েই গেলেন। পদত্যাগ হয়তো কোনো সুফল দিত না, তবে কমিশনের অভ্যন্তরে প্রতিবাদী হতে দোষ ছিল না। বরং তাঁর আজকের বক্তব্যের নৈতিক অবস্থান অনেক জোরদার হতো।

সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন দেখে তাঁর আঁচ করতে পারার কথা ছিল, জাতীয় নির্বাচনে কী হবে! সেভাবে তিনি কমিশনের সভায় বারবার বলতে থাকলে কিছু কাজ হতেও পারত। কমিশনের সভা ডাকা না হলেও তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের চিঠি দিয়ে তাঁর বর্ণিত অব্যবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে জোর আপত্তি করতে পারতেন, দিতে পারতেন যথাযথ পরামর্শ। অবশ্য এটা স্বীকার করতে হয় যে বর্তমান কমিশনের সূচনা থেকেই এই নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে চলেছেন। এমনটা হতে পারে। সূচনায় কিছু প্রশাসনিক বিষয়ে মতান্তর হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছিল। তবে জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে কমিশন কিংবা তাদের সহায়ক কেউ বর্ণিত অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে, তা আলোচিত নির্বাচন কমিশনারকে অনেক আগেই দেশবাসীর নজরে আনার প্রয়োজন ছিল।

হয়তো দেরি হয়ে গেছে। গলদ হয়েছে কোথাও। তবে একটি জাতি এভাবে থেমে যাবে না। গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়ে যাঁরা দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন, তাঁদের বংশধরেরা সে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। তারা প্রচেষ্টা চালাবেই। একটি বড় সুযোগ হয়তো গেছে। তবে আবারও আসবে। বাস্তবতাও পরিবর্তনশীল। নির্বাচন কমিশনের ওপর সংবিধান যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুসারে তা পালনে গুরুতর বিচ্যুতি হয়েছে। ভুল সংশোধন করা যায়। তবে তার জন্য দরকার সাহস ও দৃঢ়তা। কমিশন চাইলে যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়া সম্ভব, এর প্রমাণ কিছু মাত্রায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেখা গেল। তবে নির্বাচনটি সার্বিকভাবে অংশগ্রহণমূলক ছিল না। মাঠের খেলা হয়েছে মূলত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের মধ্যেই।

আলোচ্য নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য কিন্তু থেকে যাবে। কমিশন জাতীয় নির্বাচনে পাশ কাটানো দায়িত্ব পালন করল কেন? কারও পক্ষে ফলাফল নিতে কেউ চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু কমিশন শক্তিশালী অবস্থান নিলে অবস্থাটা একেবারে এই রূপ হতো না। সে অবস্থার দায়ভার তাদের নিতেই হবে। আর সাফল্য যেটুকু, তার কৃতিত্বের দাবিদারও তারাই। গণমাধ্যমে আলোচিত কিছু বক্তব্য দেওয়া নির্বাচন কমিশনারও এর সমান অংশীদার।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব