দর্শকশূন্য মিলনায়তন ও ছাত্রলীগ

একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে গিয়ে তিক্ত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। দেশবরেণ্য বহু কৃতী ব্যক্তির স্মৃতিধন্য এ কলেজে ধারাবাহিক গল্প বলা ও সাহিত্যবিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল গল্পকার নামে একটি মাসিক পত্রিকা। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। খোদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। কিন্তু যথাসময়ে মিলনায়তনে গিয়ে দেখা গেল, উপস্থিত দর্শকদের চলে যেতে নির্দেশ দিচ্ছেন কলেজেরই কিছু শিক্ষার্থী। মিলনায়তনের ফটকে দাঁড়িয়ে আগ্রহী দর্শকদের মিলনায়তনে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে তাঁদেরই আরেকটি দল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আগেভাগে অবহিত করা হয়নি বলে এ অনুষ্ঠান করতে দিতে আপত্তি তাঁদের।

কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে একটি অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কেন ছাত্রলীগের নেতাদের অনুমতি নিতে হবে, বোধগম্য হলো না। যা–ই হোক, বেশ কিছুটা সময় অচলাবস্থার মধ্যে কেটে যাওয়ার পর আয়োজকদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের আপসরফা হলো। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বক্তব্যের সুযোগ দেওয়ার শর্তে অনুষ্ঠান চালানোর জন্য সম্মতি দিলেন তাঁরা। সবচেয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করলাম ঠিক তখনই। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দিতে উঠলে মিলনায়তনে উপস্থিত শিক্ষার্থী-দর্শকেরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছেন। ছাত্রলীগের দুই নেতার বক্তব্য চলাকালে প্রায় দর্শকশূন্য হয়ে পড়ল মিলনায়তন। পরে মূল অনুষ্ঠান শুরু হলে আবার কিছু দর্শক এসে যোগ দেওয়ায় মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া গেল অনুষ্ঠান।

জানি না কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিষয়টিকে কীভাবে নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, তাঁদের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের মনে কী রকম ক্ষোভ ও দুঃখ জমা হয়ে আছে, তারই একটা প্রতিক্রিয়া যেন পাওয়া গেল শিক্ষার্থী-দর্শকদের আচরণে। মিলনায়তন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা নীরব প্রতিবাদ আছে। সেই নীরবতার ভাষা বুঝতে না পারলে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের আপাতসমাধান হিসেবে নিজেদের সংগঠনের বড় পদ বাগিয়ে নেওয়া হয়তো সম্ভব, জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হওয়া সম্ভব নয়।

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের সময় দূর থেকে বসে এর নানা সমীকরণ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারী ছাত্রলীগের নেতারা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে নিঃসংশয় ছিলেন না। এ কারণেই নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে অন্য সব কটি সংগঠনের দাবিদাওয়ার সঙ্গে বিপরীতমুখী অবস্থান ছিল তাঁদের। অথচ ওই নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, স্বতন্ত্র প্রভৃতি বহুধাবিভক্ত প্যানেল ও প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগাভাগির কারণে বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ তাদের জয়ের ব্যাপারে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারত। পারেনি, কারণ সরকারসমর্থিত দল হিসেবে ক্যাম্পাসে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করা আর সাধারণ ছাত্রদের মন জয় করা এক ব্যাপার নয়। তাই নানা অনিয়মের অভিযোগের পরও রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের মতো বহুল পরিচিত ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টিতে অনুজ্জ্বল নুরুল হককে যখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ভিপি পদে রায় দেন, তখন বিস্মিত হলেও প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারি আমরা। কিন্তু এসব ঘটনা থেকে কি কোনো বার্তা পৌঁছায় ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারণী মহল বা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র হয়ে ওঠা সংগঠনটির নেতাদের কাছে?

মনে হয় না। পৌঁছালে শিক্ষার্থী বন্ধুদের কাছে ভীতিকর না হয়ে তাঁদের সঙ্গে স্নেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন তাঁরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা দূরে থাক, নিজেদের সংগঠনের সতীর্থদের মধ্যেই তো নানা রকম কোন্দলে জর্জরিত ছাত্রলীগ। এই যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন ঘোষণার প্রাক্কালে ছাত্রলীগের চারটি উপদল পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করা শুরু করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। কয়েক দফা সংঘর্ষের জের ধরে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৪ মে। সেই থেকে কমিটি ছাড়াই চলছে কার্যক্রম। এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন আদায় পরের কথা, নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন ও এরপরে প্রার্থী মনোনয়নের দুরূহ পথ পাড়ি দিতে হবে তাদের।

গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছেন অন্ধ সমর্থকেরা, তার একটা নজির দেখা গেল সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর আগমনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে। ওই দিন উপমন্ত্রীর গাড়ির সামনেই অন্য একজন নেতার পক্ষে স্লোগান দিয়ে শোডাউন করেছেন মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। মহিবুল হাসান বর্তমান সরকারের মন্ত্রী শুধু নন, ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক সম্পাদকও। ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা যদি দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্যের তোয়াক্কা না করেন, তাহলে অন্য কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁদের কোনো ধরনের সমীহ বা সহমর্মিতা আশা করা বাতুলতা।

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকাজের টেন্ডার দখল থেকে শুরু করে প্রশাসনিক হেন কোনো কাজ নেই, যেখানে মাথা গলাচ্ছে না ছাত্রলীগ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মতো প্রক্রিয়ায়ও তাদের হস্তক্ষেপ ঘটছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ পাওয়া একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে দেননি ছাত্রলীগের কর্মীরা। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র এমদাদুল হক স্নাতক সিজিপিএ ৪–এর মধ্যে ৩ দশমিক ৮৮ এবং স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৯৬ পেয়েছিলেন। শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে গিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে থেকে অপহৃত হয়েছেন তিনি। ছাত্রলীগের কর্মীরা অপহরণ করে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন তাঁকে এবং দিনভর আটকে রেখে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।

এ রকম একেকটি ঘটনা জোড়া দিলে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের যে বিরাট তালিকা তৈরি হয়, তা এই সংগঠনের ভাবমূর্তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ভেবে দেখতে বলি শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে কোন মুখে ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভোট চাইতে যাবেন তাঁরা?

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের একটি অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের সময় যেভাবে মিলনায়তন দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে, সেই প্রত্যাখ্যানের ঘটনাটি একটি প্রতীকী দৃশ্য বলে মনে হয়েছে আমাদের। ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে যত দেরি করবেন, তত দর্শক-শ্রোতাশূন্য হতে থাকবে মিলনায়তন।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক