শিশুর বিকাশে খেলাধুলা সুন্নত

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুর বিকাশে চাই আনন্দময় শৈশব। শিশুদের লেখাপড়া ও জীবনমুখী শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও আনন্দ–বিনোদন প্রয়োজন। শিশুদের মানসিক উৎকর্ষের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ এবং পিতা, মাতা ও অভিভাবকের সঙ্গ। নিঃসঙ্গ ও নিরানন্দ জীবন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং তাকে বিপথগামীও করতে পারে।

শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিও প্রয়োজন। সুস্থ দেহের চেয়ে সুস্থ মন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য দরকার চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। খোলা মাঠ, মুক্ত আকাশ ও বিশুদ্ধ বাতাস শিশুর মনকে প্রফুল্ল করে। তাই মাঝেমধ্যে শিশুকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের ব্যস্ততা, ঘাম ঝরানো পরিশ্রম ও নির্ঘুম প্রচেষ্টা—সবই কিন্তু শিশুর ভবিষ্যতের জন্য। যদি সবকিছুই হলো কিন্তু শিশু মনের মতো মানুষ হলো না, তবে সব পরিশ্রমই বিফলে পর্যবসিত হবে। সুতরাং শিশুদের খেলাধুলা ও আনন্দের জন্য আমাদের মূল্যবান সময় দিতে হবে।

দাদা, দাদি, নানা, নানি, ফুফু, খালা এবং আপনজনদের সাহচর্য শিশুদের মানস গঠনে সহায়ক। বিশেষত পিতা–মাতাকে তাদের সঙ্গ দিতে হবে। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প করতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, ইতিবাচক বায়নাগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণের চেষ্টাও করতে হবে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিশু নাতি হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.)–এর সঙ্গে ঘোড়া ঘোড়া খেলতেন, তাঁরা নবীজি (সা.)–এর নামাজে সিজদার সময় তাঁর ঘাড়ে–পিঠেও চড়ে বসতেন।

শিশুদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী ও সমাজের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ দিতে হবে। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের চর্চা বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদের ভালো ব্যবহার শেখাও।’ ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান–খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ ‘তোমরা সন্তানদের জ্ঞান দান করো; কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি)।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো, তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেবে, সাঁতার শিক্ষা দেবে এবং তিরন্দাজি ও অসি চালনা শিক্ষা দেবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করো। কেননা তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছ।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে খেলাধুলা ও আনন্দ বিনোদন খুবই প্রয়োজন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। বিশ্ব শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুকালে ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছেন, মাঠে–ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পাহাড়ের দৃঢ়তা ও মৌনতা, ঝরনার উচ্ছলতা, নদীর গতিময়তা ও কলতান, খোলা প্রান্তরের উদারতা ও মুক্ত আকাশের বিশালতা উপভোগ করেন। তিনি কখনো কখনো খেলাধুলা পরিচালনায় নেতৃত্বও দিয়েছেন।

শিশুদের নিরাপদ ও আনন্দময় শৈশবের জন্য পিতা–মাতা, অভিভাবকসহ শিক্ষক–শিক্ষিকা এবং সব স্তরের সচেতন নাগরিকেরই দায়িত্ব রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর এ ব্যাপারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন: যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান, যার কল্যাণ চলমান থাকে; এমন জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে; এমন সৎকর্মশীল সুসন্তান, যে তার (পিতা, মাতা ও অভিভাবকের) জন্য দোয়া করে।’ (ইবনে মাজাহ)।

আনন্দময় শৈশব ও খেলাধুলা শিশুর অধিকার। যদি কোনো পিতা, মাতা, অভিভাবক শিশুকে তার এই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তবে শিশুর দোয়াও তাঁর জন্য বদদোয়ায় পরিণত হতে পারে। যেমন: কোরআন কারিমে পিতা–মাতার জন্য যে বিখ্যাত দোয়াটি রয়েছে ‘রাব্বির হামহুমা, কামা রাব্বা-ইয়ানি সগিরা।’ অর্থাৎ হে আমাদের রব! আমাদের পিতা–মাতা উভয়কে সেই রূপ করুণা করুন, যে রূপ তাঁরা আমাদের শৈশবে লালন পালন করেছেন। (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ২৪)। কোনো পিতা, মাতা বা অভিভাবক যদি শৈশবে সন্তান বা পোষ্য শিশুর সঙ্গে অযত্ন, অনাদর, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতার আচরণ করে থাকেন, তখন এই দোয়া প্রকারান্তরে শর্তমতে তাঁদের জন্য বদদোয়ায় পরিণত হবে বৈকি।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com