লোভের আগুনে যখন পুড়ে যাচ্ছে সব

আগুনে জ্বলছে এফ আর টাওয়ার। ভবন বেয়ে নিচে নামছেন কয়েকজন। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আগুনে জ্বলছে এফ আর টাওয়ার। ভবন বেয়ে নিচে নামছেন কয়েকজন। বনানী, ঢাকা, ২৮ মার্চ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রথম আলোর ২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারির খবর, সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রথম আলোর খবর ছিল, ঢাকায় ত্রুটিপূর্ণ নকশায় নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে ১০ হাজার। আর ২০১০ সালে আরেকটা খবরে বলা হয়েছিল, ঢাকায় ৯৭ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই।

বনানীর ফারুক রূপায়ণ টাওয়ারে ভয়াবহ আগুন আর এত এত মানুষের মৃত্যু আমাদের বিচলিত করেছে। এর আগে চকবাজারের আগুনে মারা গেছে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ। তারও আগে নিমতলীতে মরেছে মানুষ। পরপর দুটো বড় অগ্নিকাণ্ডে এতগুলো মানুষের করুণ মৃত্যু আমাদের অসহায় করে তুলেছে। আমরা এখন আগুন থেকে কীভাবে নিরাপদ থাকব, এই নিয়ে কথা বলছি। আজকেই, আল্লাহ না করুন, একটা ভূমিকম্প যদি হয়, আমাদের সব কথা তখন হবে ভূমিকম্প নিয়ে। তবে চাই বা না চাই, বৃষ্টিপাত তো হবেই। ঢাকায় একদিন একটু অতিরিক্ত বৃষ্টি যদি হয়, জলজটে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট অচল হবেই। তখন দেখবেন, সব কথা হতে থাকবে জলাবদ্ধতা নিয়ে। টেলিভিশনে টক শো হবে, পত্রিকায় আমরা কলাম লিখব, গোলটেবিল বৈঠক হবে। বড় বড় প্রকল্প হবে, অনেকের কপাল খুলে যাবে; আবারও দুর্যোগ আসবে, আমরা আবার কথা বলব, আবারও প্রকল্প হবে, আবারও টাকা বরাদ্দ হবে।

এসব অগ্নিকাণ্ডের একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে, মানুষ মারা গেছে আসলে লোভের আগুনে, অনিয়মের আগুনে, নৈরাজ্যের আগুনে, অপব্যবস্থার আগুনে। আমাদের ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের প্রশাসনযন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত। এবং বাংলাদেশে এখন চলছে নৈরাজ্যের কাল, লুণ্ঠনের কাল। আমরা অর্থলোভী নই, আমরা অর্থগৃধ্নু। যে যেভাবে পারি, লুটে নিতে চাইছি। আমাদের টাকা দরকার, কোটি টাকা, শতকোটি টাকা, হাজার কোটি টাকা। এই অর্থগৃধ্নুতার আগুনে সবকিছু ভেঙে পড়ছে, সবকিছু ডুবে ভেসে যাচ্ছে, সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে। সুবচন এখন নির্বাসনে, সুশাসনের কথা এখন আর কেউ বলেও না।

আমরা কথায় কথায় বলি, এই ড্রাইভারের লাইসেন্স ছিল না, এই গাড়ির রুট পারমিট ছিল না, এই বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, এই ভবনের নকশা অনুমোদিত ছিল না। কিন্তু আমরা কি কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, এই সার্টিফিকেটগুলো কাগজের চেয়ে বেশি কিছু?

রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুমোদন নিতে ১১ থেকে ১৪টা ছাড়পত্র নিতে হয়। ধরা যাক, পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে হয়, অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নিতে হয়। এবং অবশেষে স্থাপত্য নকশাটি রাজউক অনুমোদন করে। আমার বন্ধু স্থপতি ইকবাল হাবিবের কাছ থেকে জানতে পারলাম, গত আট বছরে রাজউক ৪০ হাজার ভবনের অনুমতি দিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, এই ৪০ হাজার নকশা কি রাজউক তো রাজউক, পৃথিবীর কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষেই নির্ভুলভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব! তাহলে এসব ছাড়পত্র এবং নকশা অনুমোদনের মানে কী। মানে একটাই, দুর্নীতি। আমাকে ১১ থেকে ১৪ জনের কাছে যেতে হবে, সোজা আঙুলে কিংবা বাঁকা আঙুলে তাঁদের কাছ থেকে স্বাক্ষর আদায় করে আনতে হবে।

কিন্তু আমরা আমাদের পেশাজীবী সংস্থাগুলোর ওপরই নির্ভর করতে পারতাম। কে ভবনের নকশা করতে পারবে, কে পারবে না, তার তো একটা তালিকা আছেই। থাকতে হবে। অনুমোদিত ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট ইমারত বা স্থাপনার নকশা করবেন। এবং এই নকশা করতে তাঁরা বিল্ডিং কোড মান্য করবেন। একটা কর্তৃপক্ষ থাকবে, যাদের কাজ হলো নিয়মিতভাবে মনিটর করা, কে আইনকানুন বা বিধিমালা ভঙ্গ করছেন। আইনে বিধিভঙ্গের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধানও আছে। আগামী এক মাসে ১০ জনকে ধরে শাস্তি দিন, দেখবেন, সব সোজা হয়ে গেছে।

আমাদের নির্মাণ সংস্থাগুলো কী করে? একটা ভবনের নকশা বানিয়ে রাজউকের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। তাঁদের নিয়োগপ্রাপ্ত লোক আছেন, যাঁদের কাজ রাজউকের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে অনুমোদন নিয়ে আসা। তারপর সেই নকশা থাকে কাগজে। মালিক এটা লঙ্ঘন করতে চান। নির্মাতা এটা লঙ্ঘন করতে চান। দুই ফুট জায়গা বাড়িয়ে নিলে কোটি টাকা লাভ। দুটো তলা বেশি বানালে কয়েক কোটি টাকা লাভ। একটা সিঁড়ি কম দিলে আরও কয়েক কোটি পকেটে ঢুকল। পার্কিংয়ের জায়গায় রেস্তোরাঁ বানাও। আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ, দোকান, হাসপাতাল, গোডাউন, স্কুল বানাও। অনেক বহুতল ভবনের সিঁড়ি বন্ধ। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যে লিফট ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যাবে না। সবচেয়ে ভয়ংকর ভাড়া বাসাগুলো। বাড়িওয়ালা রাত ১১টার পর বাইরের গেটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। দারোয়ানের কাছেও চাবি থাকে না। ল্যান্ড লর্ড মানে তো জমিদার। এই বাড়িওয়ালাদের সামনে ছাতা মাথায় জুতা পায়ে ভাড়াটেরা চলতে পারেন তো?

আমাদের দেশে আমরা লোকালয় বা আবাসিক এলাকা গড়ি কীভাবে? প্রথমে ধানখেত কিংবা জলাশয় ভরাট করি। একটা ছয় ফুট বা দশ ফুট রাস্তার দুধারে বাড়ি বানাই। কোনো ড্রেন নেই। বৈদ্যুতিক খুঁটি পোঁতার জায়গা নেই। বাড়িঘর উঠে গেলে হুঁশ হয়। তখন ওই সরু রাস্তা খুঁড়ে ড্রেন বানাই। রাস্তার ওপরেই বিদ্যুতের খুঁটি পুঁতি। বৃষ্টি হলে ওই রাস্তা ডুবে যায়। আমরা চিৎকার করতে থাকি, কর্তৃপক্ষ কী করে?

এখন এই দুষ্টচক্র আমরা ভাঙব কেমন করে? আমরা নিয়ম মানি না বলে সিস্টেম কাজ করে না, আর সিস্টেম কাজ করে না বলে আমরা নিয়ম মানি না। আমার এক নম্বর কথা হলো, কাগজ যেন শুধু কাগজ না হয়। আমি পরিবেশের কাগজ নিয়েছি, এর মানে যেন এই হয় যে আমার স্থাপনা পরিবেশবান্ধব এটা বাস্তবে নিশ্চিত থাকে। দুই নম্বর কথা হলো, আমাদের মনিটরিং বাড়াতে হবে। মোবাইল কোর্ট নামুক, ভবনগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করুক। ৭০ হাজার কি ৪০ হাজার ভবন পরীক্ষা করা কারও পক্ষেই সম্ভব না। প্রতিদিন যদি ৭টা ভবন আমরা পরীক্ষা করতে পারি, ৭০ হাজার ভবন পরীক্ষা করতে ১০ হাজার দিন লাগবে, যা অসম্ভব। কিন্তু এক মাসে ২১০টা ভবন পরীক্ষা করে বিধির ব্যত্যয় পেলে আইনানুযায়ী যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে দেখবেন বাকি ৭০ হাজারই নিয়ম মানার জন্য তৎপর হয়ে গেছে।

এরপর আমি তাকাতে বলব আমাদের নিজেদের দিকে। আমরা কি আমাদের বাসভবন কিংবা অফিস ভবনের ফায়ার এক্সিট, এক্সটিংগুইশার, বিদ্যুতের লাইন, গ্যাসের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করাই? আমরা কি আগুনের মহড়া করি? আমরা সবাই আমাদের বাড়িঘরগুলোকে গ্রিল দিয়ে খাঁচা বানিয়ে রেখেছি। আপৎকালে আমরা বের হব কোথায়? খাঁচাবন্দী প্রাণীর মতো ছটফট করতে করতে আমাদের মরতে হবে।

তাহলে বলার কথাগুলো চারটা দফায় সাজাই। ১. ভবনগুলো ইমারত বিধিমালা মেনে তৈরি করুন। বিধি মানা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য পরিদর্শক দল বেরিয়ে পড়ুক আর বিধিভঙ্গ হলে আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হোক। আর সেই সাজার কথা প্রচার করা হোক। ২. বাড়িওয়ালারা দয়া করে গেটের কাছে চাবি রাখুন, যাতে দরকারের সময় গেট খুলে নিরাপদ স্থানে যাওয়া যায়। ৩. পুরো বাড়িকে গ্রিলে ঢেকে না ফেলে অন্তত কিছু এসকেপ রুট রাখুন। ৪. নাগরিকদের নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। আগুন লাগার পর নেভানো বা পালানোর চেয়ে আগুন যাতে না লাগে, সেই দিকটায় আমরা যেন সবাই নজর দিই আগে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক