কিছুতেই কিছু আসে যায় না

সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

মাননীয় সরকারের মুখে এখন হরদম শুনি, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল’, আর চোখের সামনে দেখি নিমতলী-চুড়িহাট্টা থেকে বনানী, সড়ক থেকে ভবন, কারখানা থেকে অফিস, পথঘাট, সড়ক পরিবহন—সর্বত্রই মৃত্যুকূপ। মুনাফা ও মূলধন সংবর্ধনের প্রক্রিয়াকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় কীভাবে মানুষের জীবন ও সম্পদ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, এসব ঘটনা তারই প্রকাশ। কোনোটাই ছক থেকে বাইরে যায় না। ঘটনা ঘটার পরে ভাঙাচোরা উদ্ধারকাজ, হুমকি–ধমকি, কমিটি গঠন, রিপোর্ট প্রকাশের অঙ্গীকার এবং আবার সবকিছুর অন্ধ গহ্বরে প্রবেশ। প্রতিদিন সড়কে মানুষের লাশ, বছরে ৫ থেকে ৭ হাজার। এত অকালমৃত্যু, এত মানুষের হাহাকার, প্রতিদিন এত লাশ দেখে কি সরকারের কিছু আসে যায়? বছরের পর বছর একই রকম নির্মমতার পুনরাবৃত্তি দেখে–শুনে মনে হয়, মোটেই না।

খাল–বিল, খোলা জায়গা ভরাট করে, দখল করে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে অনেক। গত বছর রাজউক ঢাকা শহরে এক অনুসন্ধান চালিয়ে ২ লাখ ভবনের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ভবনে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছিল। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১০ সালে হাইকোর্ট সরকারকে এক বছরের মধ্যে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠা করে সারা দেশে তার মাধ্যমে সব নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দিয়েছিলেন, হয়নি। বছরের পর বছর সরকারি প্রতিষ্ঠান তার দায়িত্বের উল্টো কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য শত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও কারখানা, ভবন, সড়কসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই, সরঞ্জাম নেই, লোকবলের অভাব কাটে না।

বাংলাদেশের প্রাণ হলো নদী; দখল–দূষণে অনেক নদীই হয় ড্রেন, নয়তো হাওয়া। ২০০৯ সালে ঢাকার চারপাশের নদ-নদী দখল রোধে হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনাসহ রায় জারি করেন। ২০১১ সালে অন্য এক রায়ে হাইকোর্ট বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। টুকটাক উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে এত বছরে এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, এসব আদেশ ঝুড়িতে ফেলে দিলে কিছুই আসে যায় না।

ঢাকার বায়ুদূষণও বিশ্ব রেকর্ড করেছে। সব মাপকাঠিতে ঢাকার বায়ুদূষণ মাত্রাতিরিক্ত, বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। একদিকে অনিয়ন্ত্রিত ইটভাটা, পুরোনো গাড়ির বর্জ্য; অন্যদিকে গাছপালা কমে যাওয়া, মরা বা বিষাক্ত নদী, উধাও খাল, দখল করা খোলা জায়গা এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এর ফলাফল এক দিনে বোঝা যায় না, ফুসফুস, হৃদ্‌যন্ত্র, মস্তিষ্কসহ মানুষের শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এই বিষে জর্জরিত হচ্ছে, শিশুরা শৈশব থেকেই বিষ নিয়ে বিকলাঙ্গ হওয়ার পথে। অসুখ–বিসুখ বেড়ে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, জীবনীশক্তির ক্ষয় হচ্ছে। যে ধারায় ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, এই বিষাক্ত যাত্রা তারই ফল। বিশুদ্ধ নিরাপদ বাতাস, নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাবার, নিরাপদ জীবন—সবই এখন নাগরিকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারের তাতে কিছু আসে যায়?

৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের ‘অভূতপূর্ব’ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন একই মডেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, ডাকসু, উপজেলা নির্বাচন—সর্বত্রই আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা, ভোটারদের ভোট দানে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, প্রশাসন-দল-বাহিনীর সমন্বিত কার্যক্রমে পূর্বনির্ধারিত ফলাফল তৈরির প্রকল্প চলছে অবাধে। ডাকসু নির্বাচন ছাড়া আর কোথাও কোনো প্রতিরোধ হয়নি, তবে এর কারণে সরকারি ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাস এখনো চলছে। নির্বাচনের এই অবস্থা দেখতে দেখতে সাধারণ ভোটার বা নাগরিকেরা ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন, বর্জন করছেন নির্বাচনের এই অদ্ভুত খেলা। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে এই ব্যবস্থা যে পুরো ধসে পড়ল, প্রতিষ্ঠানগুলো যে অকার্যকর হয়ে গেল, তাতে কি সরকারের কিছু আসে যায়?

২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। আর মুছে ফেলা বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তার মানে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সমাধান হিসেবে অর্থমন্ত্রী খেলাপিদের আরও সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে একজন ঋণখেলাপি নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যাবেন। বাকি ঋণ শোধ করতে হবে ১২ বছরের মধ্যে। ঋণের সরল সুদহার হবে মাত্র ৯ শতাংশ। তার মানে, যাঁরা নিয়মিত ঋণ শোধ করেছেন, তাঁদের জন্য শাস্তি; যাঁরা ঋণ শোধ করবেন না, তাঁদের জন্য পুরস্কার। সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু লোকের হাতে ব্যাংকিং খাত তুলে দেওয়া হয়েছে। হাজার লাখ কোটি টাকা লুট ও পাচারের খবর বের হচ্ছেই। এতে যে অর্থনীতির মাজা ভেঙে যাচ্ছে, তাতে কি সরকারের কিছু আসে যাচ্ছে?

এলএনজি, এলপিজি, বিদ্যুৎ ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে গ্যাস–বিদ্যুতের দাম অবিরাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। তার ফলে কৃষিশিল্প, গৃহস্থালি জীবনযাপন—সবকিছুরই ব্যয় বাড়ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশকে মহাবিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা–পরিসীমা নেই, তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদি জমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। পারমাণবিক বর্জ্য নিয়ে কোনো পরিষ্কার ব্যবস্থা নেই। সরকার একদিকে বলেই যাচ্ছে, রূপপুরে কোনো দুর্ঘটনা হবে না, অন্যদিকে যেকোনো দুর্ঘটনার দায় থেকে রক্ষার জন্য রাশিয়া-ভারতের এই প্রকল্পে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য করা হয়েছে দায়মুক্তি আইন। প্রাণ–প্রকৃতি–দেশবিনাশী আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের সূত্র ধরে দেশের বনগ্রাসী–ভূমিগ্রাসী কতিপয় গোষ্ঠী তিন শতাধিক বাণিজ্যিক প্রকল্প দিয়ে সুন্দরবন ঘিরে ফেলেছে। উপকূল রক্ষাকারী বন–পরিবেশ বিনাশ করে মহেশখালী, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। উপকূলজুড়ে কয়লা–বিদ্যুতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে কমানোর বদলে সেই বিপদ আরও বৃদ্ধির মহাযজ্ঞ করছে সরকার। এদিকে এশিয়া এনার্জি বা জিএসএম বেআইনিভাবে ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে লন্ডনে শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে যাচ্ছে, এখন এই খনি নিয়েই তারা চীনের ‘পাওয়ার
চায়না’র সঙ্গে চুক্তি করেছে। বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে বিদেশি কোম্পানি বেআইনিভাবে বিদেশে ব্যবসা করে, সরকার কিছুই বলে না। আর এই চুক্তি বিষয়েও মন্ত্রণালয় বলছে, তারা কিছুই জানে না। এভাবেই চলছে দেশ! সরকারের তাতে কি কিছু আসে যায়?

যে দেশে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও ১০ বছরে পুরান ঢাকার ভয়াবহ গুদাম সরানো হয় না, আবার অকালমৃত্যুর মুখে পতিত হয় মানুষ, যেখানে একের পর বহুতল ভবন হয় কোনো রকম নিয়মকানুন ছাড়া, যেখানে লাইসেন্স-ফিটনেস ছাড়া গাড়ির কারণে বছরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়; সেখানে বলা হয়, এর চেয়ে লক্ষগুণ বিপজ্জনক, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সব ঝুঁকিমুক্ত! যে সরকার সচিবালয়ের পাশের নদীকে ড্রেনে পরিণত হওয়া ঠেকাতে পারে না, তারা বলতে থাকে, বছরে ৪৭ লাখ টন কয়লা পুড়লেও সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না! যখন হবে, তখন কে দায়ী থাকবে? হাসি–তামাশা দেখে বোঝা যায়, দেশের এ রকম সর্বনাশেও ক্ষমতাবানদের কিছু আসে যায় না।

শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান আর কমিশনভোগীদের মেদবহুল হাস্যমুখ থাকলেই হলো!

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
[email protected]