পর্যটন দরকার, কিন্তু ঐতিহ্য সুরক্ষাও চাই

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন পিয়ের্স সিয়াটলে বসবাসকারী আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের বসতি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ, সেখানে তৈরি হবে আধুনিক শহর। প্রেসিডেন্টের নির্দেশের জবাবে আদিবাসী সরদার একটি চিঠি লেখেন তাঁকে। সরদারের পাঠানো এই চিঠি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মর্যাদা পেয়েছে। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘পৃথিবী মানুষের সম্পত্তি নয়, বরং মানুষই পৃথিবীর। ...কী করে তোমরা বেচাকেনা করবে আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা? আমরা তোমাদের চিন্তা বুঝতে পারি না। বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকিমিকি, আমরা তো এগুলোর মালিক নই, তবে তোমরা এগুলো কিনবে কেমন করে?’

দেড় শ বছর আগে একজন আদিবাসী নেতা নিজের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যকে এভাবেই বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু দেড় শ বছর পরে
আমরা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কী ভাবছি, তা গত ৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে।

সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘উত্তরা গণভবন: ঐতিহ্যে কুঠারাঘাত’। খবরের সারকথা হলো, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন নাটোরের উত্তরা গণভবনকে পর্যটকদের জন্য আরও বেশি আকর্ষণীয় করার নামে ভেতর ও বাইরে নতুন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা; গণভবনের ভেতরে ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি থ্রিডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত না হলেও রাজশাহীর জনৈক ব্যক্তিকে আংশিক কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের তথ্যসংবলিত সাইনবোর্ড গণভবনের ভেতর ও বাইরে টাঙানো হয়েছে।

খবরটি পড়তে গিয়ে চোখের সামনে অনেক চেনা দৃশ্য ভেসে উঠল। রাজবাড়ীর সুদৃশ্য তোরণ, চারপাশে টলটলে জলাধার, সবুজ ঘাসের লন, টি-হাউস, লোহার বেঞ্চ, মার্বেল পাথরের তৈরি বিরাট প্ল্যাটফর্ম, শ্বেতপাথরের তৈরি চারটি মোড়া, চিনামাটির ফুলের টবে নানা রকম ফুলের গাছ, সুন্দর জ্যামিতিক নকশায় পাথর বসানো ফোয়ারা, ফোয়ারায় লোহার শিশুমূর্তি, কনকচাঁপা, বকুল, জহুরিচাঁপা বা এগপ্ল্যান্ট, হাপরমালি বা মালির ঝাড়, কপসিয়া, সুরভি বা সৌরভিকা, হস্তীগাঁদা, উদয়পদ্ম (ম্যাগনোলিয়া), যষ্টিমধু, কুরচি, ক্রেব (ফুরুস), শতবর্ষী তেজপাতা, রয়্যালপাম, ট্রাম্পেট ক্রিপার ও সুবিশাল কর্পূর বৃক্ষ। শুধু নান্দনিক অবকাঠামোর জন্যই যে এই রাজবাড়ী বিখ্যাত, তা নয়। এখানকার দুষ্প্রাপ্য গাছপালা ও ইতালীয় রীতির গার্ডেনও বাংলার উদ্যানধারায় সোনালি পালক হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এমন একটি স্পর্শকাতর স্থাপনা এবং এর অনন্য নিদর্শনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জাগল।

এই ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপনায় কার স্বার্থে, কোন অধিকারে, কী প্রয়োজনে সংস্কার ও সংযুক্তি? এর ভেতরে যে শতোর্ধ্ববর্ষী বৃক্ষগুলো রয়েছে, তার কি কোনো বিনিময়মূল্য আছে? প্রবেশপথের বাঁ পাশে যে দুটো পাখিফুলেরমাতৃগাছ আছে, তার ঋণ কি আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব? কারণ, এই গাছ থেকেই অসংখ্য কলম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মূল প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাগানো গাছও আছে। তিনি ১৯৭২ সালে সেখানে একটি কুরচিগাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছের বয়স এখন ৫০ ছুঁই–ছুঁই। প্রাচীন এই রাজবাড়ীর উত্তরা গণভবন নামকরণও বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন।

এই দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী শুধু কয়েকটি সুরম্য অট্টালিকার জন্যই বিখ্যাত নয়, এর আরও অনেক বিশেষত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে পাশ্চাত্য ধারার যে দুটো মাত্র উদ্যান রয়েছে, তার একটির অবস্থান এই রাজবাড়ীর অন্দরমহল লাগোয়া টি-হাউসের পাশে। উদ্যানটি মূলত দিঘাপতিয়া রাজাদের ইতালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। ভিন্নরীতির এমন সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক উদ্যান আমাদের দেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। উদ্যানটির সৌন্দর্যবর্ধনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে চারকোনা বেদির ওপরে স্থাপিত শ্বেতপাথরের চারটি অনন্যসুন্দর মর্মর মূর্তি। শুধু এমন একটি বিষয়কে ঘিরেই উত্তরা গণভবন সুরক্ষিত থাকা উচিত। কিন্তু
তা হয়নি। আমরা দেখেছি, ঐতিহাসিক এই প্রত্নসম্পদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একধরনের নোংরা পর্যটন ব্যবসা, যা রীতিমতো নিয়ন্ত্রণহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ। পর্যটনের নামে স্পর্শকাতর এই স্থাপনার অপব্যবহার হয়েছে। কারণ, স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। যতটা নজরদারির প্রয়োজন ছিল, ততটাই অবহেলার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে এই রাজবাড়ী। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালীরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটির অপব্যবহারও করেছেন। মূলত তারই ধারাবাহিকতা হলো বর্তমান এই আত্মঘাতী প্রকল্প, যার কোনো প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না।

উদ্যোক্তাদের কাছে প্রশ্ন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মূল নকশা অপরিবর্তিত রেখে সেখানে থ্রিডি সিনেপ্লেক্স, মোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, সুইমিংপুল—এসব বানানো কি সম্ভব? কেন বানাতে হবে? এসব বানানোর জন্য কি নাটোরে আর কোনো জায়গা নেই? আমরা জানি, এ ধরনের স্পর্শকাতর স্থাপনায় কোনো সংস্কার করতে হলেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমতি প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে কাজ করতে হয়। কিন্তু উত্তরা গণভবনের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রকল্প কীভাবে অনুমোদিত হয়ে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে, তা বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক। ১৮ বছর ধরে উত্তরা গণভবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করতে পারি, স্থাপনাটি ক্রমে অরক্ষিত হয়ে উঠেছে। জৌলুশও হারাচ্ছে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার কারণে বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যায়। যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা-ও এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। কিন্তু এসব ক্ষতির দায় কি এখন আর কেউ নেবে?

প্রস্তাবিত নকশায় দক্ষিণ পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ার, পদচারী–সেতু, পাথওয়ে, পাথওয়ে ল্যান্ডস্কেপ, গার্ডেন, ফোয়ারা, ভাসমান প্ল্যাটফর্ম, পশ্চিমে দুটি করে বিশ্রামাগার, বসার জায়গা ও সংস্কার করা ঘাট, উত্তর পাশে পাথওয়ে, পদচারী–সেতু ও ওয়াচ টাওয়ার এবং পূর্বে পাবলিক টয়লেট, ওয়াটার বুথ, পাথওয়ে, বিশ্রামাগার ও বসার জায়গা থাকার কথা বলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানে পর্যটনই মুখ্য, ঐতিহ্য নয়।

আমরা আশা করি, জেলা প্রশাসনের বোধোদয় ঘটবে এবং এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। কারণ, এই রাজবাড়ী ও সেখানকার আনুষঙ্গিক নিদর্শন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও চেতনা ধারণ করে সবকিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটন কোনোভাবেই মুখ্য বিষয় হতে পারে না।

মোকারম হোসেন : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব