আলজেরিয়া, গণতন্ত্র ও চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমীকরণ

আলজেরিয়ার আন্দোলনকারীরা এখন একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। ছবি: রয়টার্স
আলজেরিয়ার আন্দোলনকারীরা এখন একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বরাজনীতি যখন কর্তৃত্ববাদের উত্থান দেখছে, তখন আলজেরিয়ায় আন্দোলনকারীরা দুই দশকের শাসককে আপাত উৎখাত করে কিছুটা আলোর দিশা দিচ্ছেন। আপাত বলা হচ্ছে কারণ, এখনো উত্তর আফ্রিকার দেশটির গতিমুখ নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত আলজেরিয়ার আন্দোলনকারীরা তাঁদের সংযমের পরিচয় দিয়ে সহিংসতার পথ আটকাতে সমর্থ হয়েছেন।

ছয় সপ্তাহের আন্দোলন প্রেসিডেন্ট আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক বিজয় দেখেছে। আন্দোলনকারীরা এখন আলজেরিয়ার একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী, যা এমনকি গোটা বিশ্বকেই আশাবাদী করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার (মিনা অঞ্চল) দেশগুলোয় বিদ্যমান একনায়কদের অনেকেরই গদি এখনো স্থিতিশীল। অথচ কর্তৃত্ববাদী শাসন যদি আলজেরিয়ায় গণবিস্ফোরণের কারণ হয়ে থাকে, তবে তা অন্য দেশের জন্যও সত্য হওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটি হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই এখানে ভূরাজনৈতিক সমীকরণটি সামনে চলে আসছে।

গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক মাঠটি এই মুহূর্তে অনেক সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণটি কাজ করছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এখানে অতি অবশ্যই রাশিয়াকে ভুলে গেলে চলবে না। তবে চীনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধ প্রথম সমীকরণটিকেই সামনে নিয়ে আসছে। কারণ, বিশ্বায়নের এই যুগে পণ্য ও বাজারই মূল হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনের উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। শুল্কারোপের মাধ্যমে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধটি অন্তত সে কথাই বলছে।

‘আরব বসন্তের দ্বিতীয় ঢেউ’ হিসেবে যে বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে, তা আদতে কতটা, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। অবশ্য প্রথম ঢেউটিও তর্কাতীত নয়। বলা হয়ে থাকে, ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ নামে যে আরব বসন্তের শুরু হয়েছিল, তার পেছনেও ছিল নানা ধরনের সমীকরণ। শূন্য দশকের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাববলয়ের নতুন সমন্বয় প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। একই সময়ে মিনা অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব সম্প্রসারণে সচেষ্ট হয় চীন। এ ক্ষেত্রে পঞ্চশক্তি হিসেবে পরিচিত ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যেও একটি সমঝোতার কথা শোনা যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে ঠিক সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ভেনেজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ। বিশেষত, বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিকল্প খোঁজা, অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন জোট গঠন ও এর সম্প্রসারণ, চীনা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতা বৃদ্ধি এবং তাতে অন্য দেশগুলোর আগ্রহ বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্রদের জন্য। সঙ্গে ছিল দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় থাকা মিনা অঞ্চলের দেশগুলোর জনগণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।

জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যদি প্রথম আরব বসন্তের অগ্নিস্ফুলিঙ্গটি তৈরি করে থাকে, তবে বিশ্ব শক্তিগুলোর স্বার্থের নানা সমীকরণ ছিল তার চালিকা শক্তি। আরব দেশগুলোয় সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রথম বিন্দুটি প্রায় অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর তা হলো ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’। বিশেষত, তরুণ জনগোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। তরুণদের ক্ষোভের মূলে ছিল বেকারত্ব এবং এর বিপরীতে দেশগুলোর শাসক ও তাঁদের ঘনিষ্ঠদের সীমাহীন দুর্নীতি, নিষ্পেষণ ও অঢেল বিত্ত। এই বৈপরীত্যই তরুণদের রাস্তায় টেনে এনেছিল। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়ার দরুন তাঁদের পক্ষে সংগঠিত শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক ময়দান দখল করাটা কঠিন ছিল। এরই ফল হচ্ছে আজকের মিসর, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো দেশগুলোর ভঙ্গুর দশা। গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের ময়দানে হাজির হলেও নিজের পছন্দসই নেতা পাওয়ামাত্রই গণতন্ত্রের বুলিটি তারা গিলে ফেলেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ মিসর, যেখানে আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসির শাসনকেই যুক্তরাষ্ট্র শুধু মেনেই নেয়নি, পৃষ্ঠপোষকতাও দিচ্ছে। আরও বড় উদাহরণ হিসেবে হাজির করা যায় সৌদি আরবকে, যার শাসকেরা কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত উদাহরণ হলেও তারা বংশপরম্পরায় যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্র হিসেবেই পাচ্ছে। ঠিক বিপরীত বাস্তবতা বিরাজ করছে ইরানের মতো দেশগুলোর জন্য।

এবার যে আরব বসন্তের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা উঠেছে, তার প্রাথমিক বিন্দুটি আলজেরিয়া ও সুদানে। সুদানে তিন মাস ধরে চলা আন্দোলন কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে দেশটির তিন দশকের শাসক ওমর আল-বশিরের বুকে। সুশাসনের দাবি ক্রমেই কণ্ঠ খুঁজে পাচ্ছে ইরাক, জর্ডান, লেবানন, মরক্কো, তিউনিসিয়া ও ফিলিস্তিনেও। এ তালিকায় ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ইরানকেও সংযুক্ত করেছে। এর মধ্যে মরক্কো ও তিউনিসিয়া উত্তর আফ্রিকার দেশ। তিউনিসিয়া প্রথম আরব বসন্তের সূচনা বিন্দু এবং এখনো তার ক্ষতই বয়ে বেড়াচ্ছে। মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও দেশটির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। আফ্রিকা অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগের তৃতীয় সর্বোচ্চটি যায় আলজেরিয়ায়। সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যবর্তী দেশ লেবানন ভূরাজনৈতিক কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকের এই দেশ আয়তনে ছোট হলেও নিরাপত্তাসহ নানা দিক বিবেচনায় বিশ্ব শক্তিগুলোর কাছে লেবানন বিশেষ গুরুত্ব পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই গুরুত্বই তার যন্ত্রণার কারণ। সুদানে অবকাঠামো, পারমাণবিক ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, জ্বালানি তেল ও কৃষি খাতে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আর ইরাক ও ইরানের সংযুক্তি সহজেই অনুমেয়।

উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে চীন বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করে ২০০০ সাল থেকে। তখন থেকেই অঞ্চলটিতে চীন বিনিয়োগ বাড়াতে তৎপর হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসেটডকের তথ্যমতে, চীনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’, যাকে নয়া সিল্করুট বলা হচ্ছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আফ্রিকা অঞ্চল। সময়ের সঙ্গে অঞ্চলটিতে চীনের বিনিয়োগ ও সে সুবাদে প্রভাব, দুই–ই বাড়ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে চীন ফোরাম অন চায়না-আফ্রিকা (এফওসিএসি) নামের বিশেষ জোট গঠন করেছে আগেই। গত বছর এই জোটের কাঠামোর আওতায় অঞ্চলটিতে ৬ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় চীন। একইভাবে চীন-আরব জোট সিএএসসিএফের আওতায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণাও আসে গত বছর। সম্প্রতি কাতারে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে চীন আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধির আগ্রহের কথা জানিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এমনকি কাতার অবরোধকে কেন্দ্র করে উপসাগরীয় অঞ্চলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সহায়তার প্রস্তাবও দেয় চীন। একই বৈঠকে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে তারা।

এখন পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। কিন্তু নয়া সমীকরণে এই সবকিছুই বদলে যেতে পারে। কারণ, চীন কূটনীতি ও বাণিজ্যের প্রতিই বেশি মনোযোগী। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় মিত্রগুলোর একটি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। কিন্তু এই ইউএইতেই বর্তমানে দুই লাখের বেশি চীনা কর্মরত। রয়েছে বড় বিনিয়োগ। দেশটির এক জেবেল আলী বন্দর ঘিরেই ব্যবসা পরিচালনা করছে চীনের ২৩০টি প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। চাপ দিচ্ছে অস্ত্র কেনার জন্য বিভিন্ন চুক্তি করতে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ২০১৬ সালে আরব সফরের পর ২০১৭ সালের জুনে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্ররা কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে। আর এই অবরোধের কিছু আগেই অঞ্চলটি সফর করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ ধরেই যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছিল সৌদি আরব, কাতারসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি। মোটাদাগে যুক্তরাষ্ট্র মিনা অঞ্চলে যে কাজটি করছে গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার নামে, চীন ঠিক তা-ই করছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নামে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ঋণ-ব্যবসায়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টি করেছিল এবং বিশ্বায়নের নামে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিল, দীর্ঘদিনের ছড়ি ঘোরানোর জেরে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। আর এটিই চীনের তৈরি করা নতুন সমধর্মী প্রতিষ্ঠান ও জোটগুলোর প্রতি বিভিন্ন দেশের আকর্ষণের কারণ।

সব মিলিয়ে মিনা অঞ্চলে অস্থিরতার যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাকে খুব একটা নিরীহ বলা যাবে না। সবচেয়ে হতাশার বিষয়টি হচ্ছে, ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যে ক্ষোভের কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিল বা আসছে, তার নিরাময় এবারও হয়তো হবে না। বিশ্ব শক্তিগুলোর নানামাত্রিক সমীকরণ, নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীনতাই হয়তো এর বড় কারণ হয়ে থাকবে। কিন্তু এই অস্থিরতা ও গণ-আন্দোলনের আভাসটি আরেকটি যে সত্যকে সামনে আনছে, তা হলো মানুষের কথা বলতে চাওয়ার স্পৃহা। কোনো মানুষই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে বেশি দিন টিকতে পারে না। একেক দেশে এই কর্তৃত্ববাদী শাসনের দৈর্ঘ্য একেক রকম হয়। কিন্তু মানুষ ঠিকই তার অধিকার আদায়ের জন্য পথে নেমে আসে একদিন। গণতন্ত্রহীনতা যেকোনো দেশকে একটি সীমান্তিক অবস্থার দিকে নিয়ে যায়, একটু পা হড়কালেই যেখান থেকে পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সংকট হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে একটি দেশে এমন মাত্রার বিরাজনীতিকীকরণ ঘটে যে, সে সময় এই পতন উন্মুখ দেশটির দায়িত্ব অনেক সময়ই তার নাগরিকেরা নিতে পারে না। এই সুযোগে ঢুকে পড়ে বহিঃশক্তি, যা আরও বাজে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এই বহিঃশক্তির কেউ হয়তো আসে গণতন্ত্রের নামে, আর কেউ আসে উন্নয়নের নামে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক