শরীর-সম্পর্কিত শিক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য দরকার

শিক্ষার্থীদের ‘যৌনশিক্ষা’ দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে আলেম সমাজের একাংশ। বিবৃতি দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক আলেম একে ‘কুশিক্ষা’ ও ‘চরিত্রবিনাশী’ আয়োজন হিসেবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনেরও ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন তাঁরা।

বিষয়টি আসলে প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা

যৌনশিক্ষা মানে যৌনতা নয় এবং যৌনশিক্ষা নামের যে পাঠ্যসূচির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হয়েছে, বাস্তবে সঠিকভাবে বললে তা প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে জীববিজ্ঞান পাঠেরই একাংশ এটা। কিন্তু জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও মহাসচিব এই পাঠ-উদ্যোগের বিরোধিতা করে গত ৩০ মার্চ বিবৃতিতে বলেন, ‘পুঁজিবাদ ও করপোরেট লুটেরারা তাদের শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যাতে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে না পারে, সে জন্য শিক্ষা থেকে নৈতিকতার পাঠ উচ্ছেদ এবং পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।’

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দিতে গিয়ে বিদ্যমান পাঠ্যসূচি থেকে কিছু বাদ দেওয়া হয়নি। এরূপ স্বাস্থ্যশিক্ষার ফলে পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ধারণাও সমাজবিজ্ঞানসম্মত নয়। স্বাস্থ্যশিক্ষার সঙ্গে পরিবার ব্যবস্থার কোনো বিরোধ আছে বলে জানা যায় না। তারপরও এ বিষয়ে আলেমদের বিভিন্ন সংগঠনে আপত্তি আছে।

আপত্তির ধরন পুনর্ভাবনা দাবি করে

বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যন্ত আলেম সমাজের ভাবাদর্শিক প্রভাব আছে। তারা যখন কোনো বিষয়ে মতামত দেয়, তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে সবাই। এরূপ মুরব্বিসুলভ প্রভাব তাদের জন্যও ব্যাপক দায়দায়িত্ব তৈরি করেছে। আলেম সমাজের নেতারা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যখনই মতামত তুলে ধরবেন, সেটা সুচিন্তিত হবে—এমনটিই স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে।

তবে প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা নিয়ে যে মতামত পাওয়া যাচ্ছে, তা কতটা সুচিন্তিত, সে প্রশ্ন তোলা যায়। এই শিক্ষাক্রমে মূলত জেন্ডার সমতা, বাল্যবিবাহ, মাসিক, যৌনবাহিত রোগ, বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন, জননাঙ্গবাহিত রোগ ইত্যাদি বিষয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মাত্র। এগুলো কেন ‘কুশিক্ষা’ ও ‘ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতিবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত হবে?

আমরা দেখেছি, গত বছর মার্চে দেশের কিশোরীদের খেলাধুলার চর্চা নিয়ে কোনো কোনো মহল থেকে আপত্তি উঠেছে। এসব অভিজ্ঞতা বলছে, কোনো বিষয়ে মতামত প্রদানের সময় গঠনমূলক অবস্থান এবং সুচিন্তিত বিকল্প প্রস্তাবের পরিবর্তে গড়ে বিরুদ্ধাচরণের একটা সংস্কৃতি সমাজে প্রবল হচ্ছে। এরূপ মনোভাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক উদ্যোগ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বাধাগ্রস্ত হয় তার প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন। প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলে সেটা হবে ক্ষতিকর।

নিশ্চয়ই সব ধর্মে যৌন আচার-আচরণ সম্পর্কে কিছু অনুশাসন রয়েছে। সেসব নিয়েও নিশ্চয়ই কথা হওয়া দরকার। যৌন প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই অসামাজিক বিষয় নয়। আবার এর সঙ্গে শালীনতাবোধও সম্পর্কিত।

ইসলাম প্রজননের জন্য দৃঢ় বিবাহভিত্তিক যৌন আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এসব বিষয়ে আলোচনা ও জ্ঞান বিতরণের সঠিক বয়স কোনটা, তা নিয়ে কথা হতে পারে। স্কুল পর্যায়ে বর্তমানে যে প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা খুবই ন্যূনতম ধাঁচের। সেখানে মূলত জোর দেওয়া হয়েছে বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়।

আলেম সমাজ যদি মনে করে, স্কুল পর্যায়ের বদলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরে কিংবা ছাত্র–ছাত্রীদের পৃথকভাবে এরূপ প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া উচিত, তাহলে সে বিষয়ে তারা মতামত দিতে পারে। পুরো বিষয়টা সম্পর্কে তারা ধর্মভিত্তিক একটা পর্যালোচনা ও গঠনমূলক মতামত দিতে পারত। এতে তাঁদের মতামতের কারিগরি মূল্য অনেক বাড়ত। সেটা না করে সমাজের শ্রদ্ধাভাজন এই নেতৃত্ব যেভাবে পুরো পাঠ্যক্রমের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন, তা কতটা বাস্তবসম্মত হয়েছে, সে বিষয়ে পুনর্ভাবনা দরকার। আমাদের দেশে পাঠ্যসূচি প্রায় প্রতিবছর নবায়ন হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার বিষয়েও যৌক্তিক মতামত বিবেচনার যথেষ্ট সুযোগ ছিল এবং আছে।

শরীর–সম্পর্কিত তথ্য ও জ্ঞান কাজে লাগে

যৌন বিষয় ও প্রজনন স্বাস্থ্য জীবনের অংশ হলেও বাংলাদেশে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় অনেক রাখঢাক আছে। এরূপ রাখঢাক কতটা জরুরি এবং এর কতখানি পরিবর্তন প্রয়োজন, সেটা নিয়ে ইতিবাচক মনে ভাবা অপরিহার্য। প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার সঙ্গে রয়েছে সুস্থ-সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাওয়ার সম্পর্ক। জীবনের জন্য অপরিহার্য এসব বিষয়ে অসচেতনতা ও সঠিক শিক্ষার অভাবে প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ ভুগছে। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতিও প্রচুর। হাসপাতাল ও চিকিৎসক দিয়ে নয়, শিক্ষা ও সচেতনতা তৈরি করে এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। গোপনে অপচিকিত্সকদের হাত থেকে বাঁচতেও এটা জরুরি।

আমরা যখন গর্ভপাতের বিরোধিতা করি, তখন ভুলে যাই, প্রয়োজনীয় শিক্ষা থাকলে অসময়ে গর্ভধারণই হতো না। যৌনশিক্ষা যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা পেতেও শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সাহায্য করে, যা ইতিমধ্যে সর্বগ্রাসী সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে সুপরিচিত সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২৮ ভাগ শিশু-কিশোর-কিশোরী কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। এর ৫৬ ভাগ বলেছে, পরিচিত পরিবেশেই তাদের এই খারাপ অভিজ্ঞতায় পড়তে হয়েছে। এরূপ হয়রানির সঙ্গে সমাজে ক্ষমতা সম্পর্কের প্রবল যোগ থাকায় ‘ঘটনা’গুলো কোনো না কোনোভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়। অথচ হয়রানির শিকার শিশু-কিশোর-কিশোরীকে জীবনের দীর্ঘ সময় এসব দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়।

মুশকিল হলো, বাংলাদেশে আমরা এসব নিয়ে কাউকে কথা বলতে দিতে চাই না। আমরা ধরে নিয়েছি চারপাশটা ‘নিরাপদ’। কার্যত তা নয়। মাঠপর্যায়ের নিবিড় গবেষণায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অবাণিজ্যিক যৌন নিপীড়নের উদ্বেগজনক চিত্রই মেলে। বড়দের তরফ থেকে কোনটা শিশুতোষ ‘আদর’ আর কোনটা অনৈতিক ‘যৌন হয়রানি’, সেই পার্থক্য করতে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে পারে তার শরীর–সম্পর্কিত জ্ঞান।

প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা উদ্যোগটি এ রকম বহু বিবেচনায় দরকারি। এটা অন্য কোনো শিক্ষার বিকল্প নয়—সম্পূরক মাত্র। বর্তমানে ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। বয়ঃসন্ধিকালে এদের মধ্যে অনেক কৌতূহল তৈরি হয়। তার সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত উত্তর তাদের কাছে থাকা জরুরি। এদের লক্ষ্য করেই স্বাস্থ্যশিক্ষার এই উদ্যোগ। যেসব স্কুলে এসব পাঠক্রম চলছে, সেখানে সামান্য ব্যতিক্রম বাদে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উদ্যোগটি ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বলেই দেখা যায়। বিবিসি বাংলা বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব মাদ্রাসাকে এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানেও ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।

সঠিক তথ্য ও জ্ঞানের বিকল্প নেই। এ পথেই কেবল আমরা নবীন প্রজন্মকে সুস্থ ও স্বাভাবিক শরীরচিন্তার পথে পরিচালিত করতে পারি। শরীর–সম্পর্কিত স্বাভাবিক বোধ মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠারও শর্ত।

সন্দেহ নেই, এ ধরনের শিক্ষা উদ্যোগ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়াই উত্তম। প্রয়োজনে আপত্তি উত্থাপনকারীদের সঙ্গেও খোলামেলা কথা হতে পারে। জাতীয় স্বার্থে নেওয়া সুচিন্তিত কোনো কর্মসূচি রাজনৈতিক বিবাদে অন্তর্ভুক্ত না হওয়াই কাম্য।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক