মোদি-মমতার ছায়াযুদ্ধ

নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছায়াযুদ্ধ হলেও একটি বিষয়ে রয়েছে দুজনের সরাসরি সংঘাত।

মিথ্যাচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিপক্ষ মানেন নরেন্দ্র মোদিকে। একান্ন মিনিটের ভাষণে মমতার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমি মোদির মতো মিথ্যা কথা বলি না।’ মানে বলি, তবে ‘মোদির মতো’ না। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারের প্রথম দিনে এভাবেই দ্বৈরথে মোদি-মমতা। পাল্টাপাল্টি জবাব, বাগ্‌যুদ্ধে সরগরম রাজ্য রাজনীতি।

শিলিগুড়ির কাওয়াখালী থেকে কলকাতার ব্রিগেড ময়দান। মমতাকে কটাক্ষ করে মোদি বলেছেন, ‘পিসি-ভাইপো মিলে লুট করছে (পশ্চিম) বাংলাকে।’ পিসি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সাংসদ-ভাইপো অভিষেককে টেনে এনেছেন তিনি। চিটফান্ড ইস্যুতে মমতার সঙ্গেই তোপ দেগেছেন তাঁর মন্ত্রী, বিধায়ক-সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। আবারও আশ্বাস দিয়েছেন, ‘ক্ষমতায় এলে চিটফান্ডের দোষী ব্যক্তিদের কেউ ছাড়া পাবেন না। জগাই মাধাইদের শেষ করবে বিজেপি।’ রাজ্যের উন্নয়নে মমতাকে বলেছেন ‘স্পিডব্রেকার’। দাবি করেছেন, ‘সারা দেশে আমি যে স্পিডে কাজ করেছি, এখানে করতে পারিনি। কারণ, এখানে স্পিডব্রেকার রয়েছেন, যাঁকে সবাই দিদি বলে ডাকেন।’

উত্তরবঙ্গে দাঁড়িয়েই মোদির উত্তর দিয়েছেন মমতা। দেড় শ কিলোমিটার দূরত্বে কোচবিহারের দিনহাটায় মমতা বলেছেন, ‘এক্সপেয়ারি প্রাইম মিনিস্টার’। ওনাকে আর প্রধানমন্ত্রী বলব না, ‘এক্সপেয়ারি বাবু বলব। কেননা, কেন্দ্রে সরকারের এক্সপেয়ারি হয়ে গিয়েছে।’ সরাসরি রাফালে দুর্নীতির কথা না তুললেও চিটফান্ড কেলেঙ্কারি ঢাকতে বলেছেন, ‘চোরের মায়ের বড় গলা, শূন্য কলসি বাজে বেশি।’ তা ছাড়া বিজেপি তো লুটেরাদের টিকিট দিয়েছে, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের টিকিট দিয়েছে। ‘জগাই মাধাই’ বলায় পাল্টা দাবি করেছেন, ‘ওই স্লোগান তো আমিই তুলেছিলাম, সিপিএমের লোকেরাই সকালে বাম, দুপুরে কংগ্রেস, বিকেলে বিজেপি।’

কদিন আগেই সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে বিস্ফোরক তথ্য। দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে আধা কিলোমিটারের মধ্যে এক পরিবারের হাতে ৩৫টি প্লট। কোথাও জমি, কোথাও ফ্ল্যাটবাড়ি। এবং সব কটির মালিকানাই একটি মাত্র পরিবারের হাতে। যে পরিবারের অন্যতম সদস্যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত মাসেই, ব্যাংকক থেকে ফেরার সময় দমদম বিমানবন্দরে শুল্ক দপ্তরের তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে অভিষেকের স্ত্রীকে। অভিযোগ, সঙ্গে ছিল দুই কেজি সোনা। অভিষেকের স্ত্রীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে বিমানবন্দরে এসে শুল্ক দপ্তরের সঙ্গে বচসায় জড়ায় রাজ্য পুলিশ। অথচ, ঘটনার এক সপ্তাহ বাদে অভিযোগ করে শুল্ক দপ্তর। প্রশ্ন, শুল্ক দপ্তর কেন আটকায়নি? শুল্ক দপ্তর তো কেন্দ্রের হাতে। তাহলে কোন বোঝাপড়ায় ছেড়ে দেওয়া হলো? কেন অভিযোগ জানাতে এত গড়িমসি? এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও শেষে তৃণমূলের নির্বাচনী দপ্তরে বসে সংবাদ সম্মেলন করেন অভিষেক। নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে।

আসলে নীতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা—যেকোনো প্রশ্নে তৃণমূল, বিজেপি একে অপরের পরিপূরক। কোনো ফারাক নেই।

মোদি বলছেন, গণতন্ত্র আক্রান্ত। ঠিকই তো। পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র ২০১১ থেকেই আক্রান্ত। তারপর গোটা দেশে। কোথাও কারও কথা বলার অধিকার নেই। না দেশে, না রাজ্যে। ভিন্নমত হলেই ‘আরবান নকশাল’, না হলে দেগে দেওয়া হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’র তকমা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়। ত্রিপুরায় বিজেপি সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। একেবারে ৯৯ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়।

কাজ কোথাও নেই। দেশে নেই, পশ্চিমবঙ্গে নেই। মোদি বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি বেকারের কাজ দেবেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, রাজ্যে বেকারি কমে গেছে ৪০ শতাংশ। যে যা খুশি বলছেন। অথচ, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য, যা সরকার চেপে রাখার চেষ্টা করছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পাঁচ বছরে কাজ হারিয়েছেন ৫ কোটি। শিল্প, কৃষি দুইয়েই সংকট। বন্ধ হচ্ছে ছোট, মাঝারি শিল্প। বেসরকারীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে লাভজনক সরকারি সংস্থা। কেন্দ্র, রাজ্য উভয়েই বন্ধ রেখেছে শূন্যপদে নিয়োগ।

রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, শিক্ষায় ইন্টার্ন নিয়োগের কথা। দিনে ৬৬ টাকা ভাতা। যেখানে কেরালায় অসংগঠিত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৬০০ টাকা, সরকারি প্রকল্প রেগায় দিনে মজুরি ১৯২ টাকা। অন্যদিকে, চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবু শিক্ষকেরা নিয়োগ না পেয়ে ২৭ দিন অনশনে। যেমন শুরুতেই অ্যাপ্রেনটিস আইন সংশোধন করেছে মোদি সরকার। এতে মালিকেরা এখন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অ্যাপ্রেনটিস রাখতে পারেন। মানে স্থায়ী বা ঠিকা কর্মীদের মতো একই কাজ করলেও, তাঁরা মজুরি পান স্থায়ী কর্মীদের সামান্য অংশ।

কৃষিতে স্বাধীনতার পর এমন সংকট কখনো আসেনি। কৃষক পাচ্ছেন না ফসলের দাম। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবেন। এক ধাপ বাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকের আয় তিন গুণ করেছেন। দুটোই হাস্যকর দাবি। গত তিন বছরে দেশে ৩৬ হাজার কৃষকের আত্মহত্যা। মানে প্রতি ৪৫ মিনিটে একজন কৃষকের আত্মহত্যা। আগে পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। বামপন্থীরা যখন রাজ্য সরকারে, তখন ৩৪ বছরে ফসলের দাম না পেয়ে একজন কৃষকেরও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এখন ঘটছে। ৮ বছরে ২০২ জন। কৃষিতে বিদ্যুতের দাম এক ধাক্কায় বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। কলকাতার বাজারে আলু কুড়ি টাকা কেজি, যেখানে কৃষক বিক্রি করছেন মাত্র দেড় টাকায়।

কেন্দ্র, রাজ্য—দুই জায়গাতেই দুর্নীতি। দিল্লিতে রাফালে দুর্নীতি। কলকাতায় সারদা, নারদ কেলেঙ্কারি। দিল্লিতে মোদি থাকলে তাই কলকাতায় মমতা নিরাপদ। এপ্রিল, ২০১৩। ফাঁস হয় সারদা কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারির শিকার ১৮ লাখ মানুষ। হারিয়েছেন ১০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর ধরে বিষয়টি পরিণত হয়েছে প্রহসনে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো বহু আগেই তৎপর হওয়া যেত। লাখ লাখ চিটফান্ডে আমানতকারী কোটি কোটি টাকা যাঁরা আত্মসাৎ করেছেন, তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া যেত। দেওয়া হয়নি। কেবল সারদা নয়। গত আট বছরে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি চিটফান্ড সংস্থা বাজার থেকে তুলেছে ২ লাখ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার, সিবিআই, ইডি কেউ সারদা কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে কিছু করেনি। সংসদে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন লালকৃষ্ণ আদভানি। এক দিনও সেই কমিটি বসেনি এ নিয়ে।

এটা বোঝাপড়া নয়তো, কাকে বলে বোঝাপড়া। মোদি বলেছেন, ‘দিদির নৌকা এবার ডুবতে চলেছে।’ অথচ, পাঁচ বছর ধরে মোদিই এই নৌকার ফুটো মেরামতের কাজ করে গিয়েছেন। আসলে সামনে ভোট। তাই ‘যুদ্ধ’ ‘যুদ্ধ’ ভাব। মক ফাইট। গড়াপেটার খেলায় নতুন সেটিংস।

শান্তনু দে: কলকাতার সাংবাদিক