হরেক রকম ধান্দাবাজি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রিকশায় করে যাচ্ছি। আচমকা ধূসর কী যেন একটা সামনে এসে ঝুলে রইল। চমকে উঠে দেখি, ইয়া বড় এক হাতি শুঁড় বাগিয়ে ধরেছে। আর ঘন ঘন বিচিত্র শব্দ করছে।
হাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে অল্প বয়সী এক তরুণ। বয়স ১৮-১৯। চেহারা নির্বিকার। যেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ে চলেছেন। কিন্তু আমি লক্ষ্মণ সেন যাই কোথায়? দুপাশে দালানকোঠা, পেছনে গাড়ির সারি। হস্তী বাহাদুর শুঁড়ে তুলে একখান আছাড় মারলে কে ঠেকাবে?
আমার যে রিকশাচালক, সেও অল্প বয়সী তরুণ। ভাবগতিকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। বয়সটাই এমন, যা দেখবে, ওতেই মজা। সে দাঁত বের করে বলল, ‘টাকা না দিলে ছাড়ত না। কিছু দ্যান, স্যার।’
এর মধ্যে কৌতূহলী ছেলে-ছোকরার ভিড় জমে গেছে। সিনেমারে শুটিং আর কি। পেছনে রিকশার ক্রিং ক্রিং আর গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। সং সেজে বসে থাকার চেয়ে কিছু দিয়ে ল্যাঠা চুকানোই ভালো।
সে রকম বিপদে পড়লে নিজের হাত-পাও কথা শোনে না। পাঁচ-দশ টাকা হাতড়াতে গিয়ে উঠে এল ৫০ টাকার নোট। তাই দিয়ে খালাস। গজ বাহাদুর সদর্পে এগিয়ে চলল আরেকটা শিকার ঘায়েলে।
বনজঙ্গল হলেও নাহয় হাতির এই মাস্তানি মেনে নেওয়া যেত, দিনদুপুরে খোদ রাজধানীর বুকে এত মানুষের সামনে অবর এক প্রাণীর কাছে জিম্মি হওয়া মেনে নেওয়া যায়?
মেনে না নিয়েই–বা করব কী? এ দেশে একসময় যে গন্ডার বাস করত, ওরা বিলুপ্ত হওয়ার পর ওদের নমুনা তো দু-চারজনকে রাখতে হবে। আমরা অভাগারা আছি কী জন্য?
এটা কিন্তু ধান্দাবাজেরা ভালো করেই জানে। এ জন্য মাথায় চৌদ্দটা কাঁঠাল ভেঙে খায়। বাজারে এক পাক ঘুরে আসুন, মুণ্ডু ঘুরে যাবে।
এক কেজি সাইজের বৈশাখী ইলিশ হাঁকছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। কী মুরগি জানি না, ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে বলে, ‘সাচ্চা দেশি!’ একেকটার দাম ৭০০-৮০০ টাকা। দামের ঊর্ধ্বগতিতে রকেট ফেল!
হতাশা বুকে চেপে ঘরে যে ফিরব, সে জো নেই। দরদি বন্ধু সামনে খাড়া। পরিচিত মাছ বিক্রেতা বলে, ‘নেন স্যার, দেশি কই। আপনার লাইগাই আনছি!’
ভাবগতিকে সহোদর না হলেও এর কাছাকাছি। মাছ অবশ্য লোভনীয়, কিন্তু দামে বিস্কুট দৌড়ের বিস্কুট। মুখের ওপর ঝুলছে, লাফিয়ে পেড়ে খেতে কষ্ট। পিছলে যে ফসকে যাব, সে জো নেই। তার দুহাত ভরা ছাই। মুখে রসগোল্লা বোল, ‘আপনেরা না দিলে কই পামু, স্যার? এই দেশি মাছ জোগাড় করা কী চাট্টিখানি কথা! এইগুলা কিনছিই বেশি দামে!’
মাছওয়ালা বিনে পয়সায় কিছু জ্ঞানও দিল। বলল, ‘মুরগিওয়ালার কাছ থিকা একবার ফিরলে দ্বিতীয়বার আর যাবেন না, স্যার। পরে ওই মুরগি দিত না। পাল্টাইয়া ছোটগুলা দিব। টের পাইবেন না।’
এই জ্ঞান দিতে দিতে থলেতে গুনে গুনে ২৪টা কই তুলে দিল মাছওয়ালা। বাসায় গিয়ে দেখি ২০টা। ওই জ্ঞান দিতে দিতে কারবার সেরেছে।
এবার এক সজ্জন ভাইয়ের কথা বলি। ওই ভাই কারওয়ান বাজার থেকে শখ করে বিশাল এক রুই কিনলেন। কিছু টাকা খরচা করে মাছটা কাটালেনও। বাসায় নিয়ে দেখেন পেটির একটা বড় অংশ নেই।
আরেক দিন একই ভাই এত বাজার করলেন যে সেগুলো বয়ে নিতে মিন্তি ভাড়া করতে হলো। তিনি যাচ্ছেন, মিন্তিও যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন চেঁচাল, ‘স্যার, আপনের টেকা পড়ছে।’
সচকিত হয়ে পেছনে তাকালেন তিনি। না, টাকা পড়েনি। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়েছে। মিন্তি বমাল হাওয়া।
আরেকবার আরেক ভাই দুটো মিন্তি নিয়েছিলেন। গাড়ির কাছে গিয়ে দেখেন, একজন সওদাভর্তি ঝাঁকা নিয়ে পিছু পিছু এসেছে ঠিকই, আরেকজনের খবর নেই। গাড়ির কাছে ওই মিন্তিকে দাঁড় করিয়ে আরেকজনকে খুঁজতে গেলেন তিনি। খানিক পর বিরস মনে ফিরে এসে দেখেন এই বেটাও সওদা নিয়ে হাওয়া!
আমার অভিজ্ঞতাও কী কম? একবার বেশ মোটা মোটা শিং মাছ কিনে নিয়ে গেলাম। বাসায় নিয়ে দেখি একেবারে রোগাপটকা। কী করে ওদের স্বাস্থ্যহানি ঘটল তা গবেষণার বিষয়। তবে বেলতলায় দ্বিতীয়বার আর যাইনি।
অফিস ছুটির পর প্রায়ই বাজার করে ফিরি। বিশেষ করে সবজিটা কিনি। কিন্তু এক দোকান থেকে পাঁচ-সাতটা সবজি কিনলে বাসায় ফিরে দেখা যায় একটা-দুটো আনাই হয়নি। একদিন এক দোকান থেকে বেশ কিছু সবজি কিনলাম। বাসায় গিয়ে দেখি টমেটোসহ তিনটা সবজি নেই। পরের দিন ওই দোকানে গিয়ে দেখি অন্য একজন বসে আছে। আগের দোকানির খোঁজ করতেই সে বলল, ‘হ্যায় তো এক মাসের লাইগা বাড়ি গেছে গা।’
ওই গেছে তো গেছে। এমন ঘটনা ঘটল একাধিকবার। প্রথম প্রথম মনে হতো, এ নিজের উদাসীনতা।
একদিন খুব সতর্ক রইলাম। এক দোকান থেকে বেশ কিছু সবজি কিনলাম। চারটা পলিথিন ব্যাগে ভরা হলো সবজি। দাম হিসাব করে দোকানি পটাপট ব্যাগগুলো তুলে দিল হাতে। কিন্তু তিনটা দিয়েছে, আরেকটা কই? দোকানিকে বলতেই সে একটা ঝাঁকার আড়াল থেকে ওই ব্যাগ বের করে দিল। মুখে লাজুক হাসি, যেন ভুলে গেছে।
অনলাইন কেনাকাটায় যান, সেখানেও কি কম তেলেসমাতি? দেখাবে একটা, দেবে আরেকটা। ভালো প্রতিষ্ঠান অবশ্যই আছে। ঠকে যাওয়ার ঝুঁকিও কম নয়। আমার সামনেই এক সহকর্মী অনলাইনে ফরমাশ দিয়ে একটা ব্যাগ আনালেন। দামের সঙ্গে ব্যাগের দামটা ঠিক যায় না। তাও নাহয় মেনে নেওয়া গেল, টাকা নিয়ে ব্যাগবাহক চলে যাওয়ার পর আবিষ্কৃত হলো ব্যাগের এক জায়গায় একটা ফুটো। কেমন লাগে!
অনলাইনে খাবারের লোভনীয় মেনু আর জিভ উতলা করা ছবি দেখে সপরিবারে গেলাম সেই রেস্তোরাঁয়। বেশ ফিটফাট রেস্তোরাঁ। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে গরম-গরম খাবার পরিবেশন করল। ছবির সঙ্গে খাবারের চেহারা মেলে না। সেগুলো মুখে দিয়ে হতাশ।
এমন ধান্দাবাজি একটা-দুটো নয়, অজস্র। ঢাকার মানুষ নানাভাবে ঢাকা, রুদ্ধ। রাস্তায় যানজট-দুর্ঘটনা নিত্যকার সমস্যা। একটুখানি স্বস্তির জন্য বুকভরে কেউ বাতাস যে নেবে, সেটাও দূষিত। কোথাও বেড়াতে গেলে রাজ্যের ভিড়। আছে দৈনন্দিন নানা ঝুটঝামেলা, হয়রানি। এর মধ্যে একটুখানি সুবিধা বা বৈচিত্র্যের জন্য উন্মুখ থাকে মন। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটে নানা ধান্দাবাজ।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]