এখন বাজার বদলে গেছে, আমাদেরও বদলাতে হবে: রুবানা হক

>
পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতি হচ্ছেন মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক। ৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পোশাকশিল্পের মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, সংকট ও সম্ভাবনার কথা। তাঁর মত, এখন বাজার বদলে গেছে। নিজেদেরও বদলাতে হবে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রধান বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন। 

প্রথম আলো: শুরুতে আপনাকে অভিনন্দন। জানতে চাই, এ পর্যন্ত আসার ক্ষেত্রে আপনার যাত্রাটা কেমন ছিল?

রুবানা হক: যেকোনো ধরনের প্রাপ্তিকে ঠিক খুব বড় কিছু এখন আর মনে হয় না। কারণ একটাই, ব্যক্তিগত জীবনে এত ঝড়ঝাপটা গেছে যে প্রতিটি দিনকেই মনে হয় এটা আরেকটা কাজের দিন। সুতরাং কাজ করতে হবে।

আমি যে খুব স্বপ্ন দেখি, তা না। তবে কল্যাণের স্বপ্ন দেখি। আসলে জীবনে এমন একটা সময় এসেছে, এখন খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবতে হয় না, খুব চাহিদাও নেই। সবই তো এখন আছে। বাড়ি আছে, ছেলেমেয়েও বড় হয়ে গেছে। তাই এখন প্রতিদিনই প্রশ্ন করি, আর কত? আর যেহেতু কিছু চাওয়ার নেই, তাহলে এবার দেওয়ার সময়।

কিন্তু দিতে হলে তো একটা পথ বেছে নিতে হয়। আমি মনে করি, তৈরি পোশাক খাতই আমার জন্য সে পথ। এখানে একটা ভালো কাজ যদি করি, একটা ভালো সিদ্ধান্ত যদি নিই, তাহলে বহুজনের ভাগ্য বদলে যাবে। আমি তাঁদের সুখের জন্য যেমন দায়বদ্ধ হব, তাঁদের কষ্টের জন্যও হব। সুতরাং খুব সাবধানে এগোতে হবে। আমাকে কাজ করতে হবে, আমি কাজ করব।

প্রথম আলো: আপনার কাজের জায়গাটি মূলত নারী শ্রমিকপ্রধান একটি খাতে। এই যে বিপুলসংখ্যক নারী পোশাকশিল্পে কাজ করেন, আপনি বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, এই সংবাদে তাঁরা কেন খুশি হবেন?

রুবানা হক: তাঁরা তখনই খুশি হবেন যখন তাঁরা অনুভব করবেন সহমর্মিতার জায়গাটায় একজন নারী এসেছেন। নারী তো মায়ের জাত। আমাদের একটা অহংকার আছে যে আমরা বোধ হয় অন্য দশটা পুরুষের চেয়ে বেশি বুঝি। কারণ, আমাদের অনেক মানিয়ে চলতে হয়। সুতরাং আমার নারী শ্রমিকেরা যখন শুনবেন আমার কথা, আমাকে তাঁরা বুঝতেও পারবেন।

আমি তো মনে করি আমি মানুষটা খারাপ না। আত্মরক্ষামূলক না। মনে হচ্ছে আস্থার জায়গাটায় নিয়ে আমরা আরও কিছু কাজ করতে পারব। আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে বিশ্বাস করি, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কটা সুন্দর হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: কিন্তু পোশাক মালিক, পোশাক খাত, বিজিএমইএ নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। এটা কীভাবে সামলাবেন?

রুবানা হক: আমি মনে করি আমাদের অনেক ভালো কাজ আছে। আমি এসব ভালো গল্পের একটা সেল বা কেন্দ্র করে দেব। আমাদের অনেকেই অনেক ভালো কাজ করেন। কিন্তু গণমাধ্যমকে প্রবেশাধিকার দিতে চান না, ভয় পান। কি-না-কি লেখে ফেলবে, সেই ভয়। এই জায়গাটা নিয়ে কাজ করতে চাই। যিনি যা ভালো কাজ করছেন, সেটাই যেন প্রচার পায়। আমি মনে করি বাংলাদেশের প্রতিটি ভালো গল্প প্রচার হওয়া উচিত। কেননা আমাদের পোশাক খাতে যত বিচ্যুতি আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক গল্প আছে। ওই দায়িত্বের জায়গাটা যদি আমি নিয়ে নিই, যদি বলি মিডিয়াকে ঢুকতে দেন, তাহলে কিন্তু গল্পটা বদলে যাবে। পারস্পরিক আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে হবে।

প্রথম আলো: কিন্তু আমরা তো দেখি ভিন্ন ঘটনা। আন্দোলন হলে, তা দমন করতে গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুতি, পুলিশ দিয়ে দমন, এমনকি গুম-হত্যার অভিযোগও আছে। এ অবস্থায় আপনি আস্থার জায়গাটা ফেরাবেন কীভাবে?

রুবানা হক: অনেক সময় আসলে আমরা সংকটকে বড় হতে দিই। অনেক সময় আমাদের প্রয়োজনীয়তাটাকে বাড়াই। এটা আসলে অন্যায়। অনেক সময় দেখা যায় সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো ঘটনা দ্রুত প্রশমিত করা যায়। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, একটা ‘গুড অ্যাম্বাস্যাডারশিপ’-এর ঘাটতি আছে পোশাক খাতে। আমার মনে হয় শ্রমিকদের সঙ্গে আমি ভালোভাবে কথা বলে, মমতা দিয়ে বুঝিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।

তা ছাড়া, যে দেশে সবচেয়ে বেশি কমপ্লায়েন্স কারখানা আছে, সবচেয়ে বেশি ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ আছে, যে খাত নারীর ভাগ্য বদলে দিয়েছে, সেই দেশে কেন আমরা ভালো গল্পটা বলব না। কেন আমরা অর্থনৈতিক-কূটনীতিকে এগিয়ে নিতে পারব না।

আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই। পোশাকের লেভেলে বারকোড দিয়ে শ্রমিকের ভালো গল্পগুলো দিয়ে দিতে পারি। তখন সবাই স্ক্যান করে জানতে পারবে আমরা কী করছি। এতে ১০ সেন্টও বাড়তি খরচ হবে না। ক্রেতারা না দিক, বিজিএমইএর তো তহবিলও আছে। সেখান থেকে আমরাই এটা করতে পারি। আমার এ রকম ছোট ছোট ভাবনা আছে, আমার মনে হয় এটা ভালো ফল দেবে।

রুবানা হক।  ছবি: প্রথম আলো
রুবানা হক। ছবি: প্রথম আলো


প্রথম আলো: শ্রমিক অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে, এই অধিকার আপনারা দিতে চান না।

রুবানা হক: শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে আমাদের কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। ট্রেড ইউনিয়ন শুনলে আমরা যে কেউ ভয় পাই। তবে ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেটরি কমিটি কিন্তু করছি আমরা। আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। এই কমিটি ভালো কাজও করছে। তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক ইউনিয়ন অনুসরণ করতে হলে তা ধীরে ধীরে এবং আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আমাদের যদি ধরেবেঁধে শ্রমিক ইউনিয়ন ব্যবস্থা মানাতেই হয়, তবে আমরা যেন তা আমাদের মতো করে গুছাই।

প্রথম আলো: আমাদের মতো করে—এর ব্যাখ্যা কী?

রুবানা হক: আমার একটা পরিকল্পনা আছে। শ্রম আইনে যদি একটা সংশোধন আনতে পারতাম যে জেন্ডারভিত্তিক ইউনিয়ন তৈরি করা হবে। যেমন যে কারখানায় ৮০ শতাংশ নারী আছেন, সেখানে নেতৃত্ব দেবেন একজন নারী। তাহলে কিন্তু এতে চেহারা বদলে যাবে। অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে।

প্রথম আলো: দেখা গেছে, আমরা যা কিছু মেনে নিই সব বাইরের চাপে। রানা প্লাজার পর যেমন ক্রেতাদের চাপে অনেক কিছু করেছি। বিজিএমইএ নিজেরা কেন কখনো বুঝতে পারে না তাদের আসলে কী দরকার?

রুবানা হক: আসলে আমরা খোলা মন নিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না। আমাদের বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। এই যেমন ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কথাই ধরি।

প্রথম আলো: আমার পরের প্রশ্ন এটা নিয়েই ছিল।

রুবানা হক: আমিই উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। এই যে অ্যাকর্ড, তাদের সব প্রকৌশলী কিন্তু বাংলাদেশি। আমরা যদি তাঁদের নিয়ে নিতে পারতাম, তাহলে কিন্তু আমরা পাল্টা একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারতাম। আমরা পারিনি। আমরা তো অনেক ধাক্কা খেয়েছি, তাই যখনই প্রথম কোনো প্রস্তাব আসে, প্রথম প্রতিক্রিয়াই হয়, এটা করার দরকার কী। এসব নিয়ে আসলে কাজ করতে হবে। এখন আমি যদি নিজস্ব মনিটরিংয়ের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে পারি, আমাদের সম্মানের জায়গাটা তৈরি করতে পারি, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো। কারণ আমরা আর বাইরের প্রেসক্রিপশন শুনতে রাজি না। আমাদের সম্মানের জায়গাটা আমাদেরই ঠিক রাখা উচিত।

 প্রথম আলো: কম মূল্য পাওয়ার অভিযোগ করেন ক্রেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আপনারাই তো দর-কষাকষি করতে পারেন না। একজন একটি দাম বললে অন্য এক মালিক এসে কম দামে পোশাক দিয়ে দেন। এর সমাধান কী?

রুবানা হক: আমাদের একজন পরিচালক কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করেছেন। তাঁরা চারটা কোম্পানি মিলে একটা কোম্পানি করেছেন। এখন তাঁরা একজোট হয়ে দর-কষাকষি করেন। এতে তাঁরা লাভবানও হয়েছেন। আমি তাঁদের বলেছি, তাঁদের এই মডেল সবাইকে বলতে। আর আমি মনে করি বিজিএমইএতে ক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য একটা সেল করে দেওয়া উচিত। আমাদের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবসা বায়িং হাউসের মাধ্যমে। কারণ আমরা এই জায়গাটা বুঝি না। এখন আমরা তাঁদের এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারি। তাঁদের যদি বলতে পারি কথা বলার সময় আমাদের সঙ্গে নিয়ে নেন, তাহলে হয়তো অনেকটা কাজ হবে।

এখন কিন্তু বাজার বদলে গেছে। আগের মতো নেই। আমাদেরও বদলাতে হবে। আমাদের বাজার বের করতে হবে, মিশন-ভিশন পাল্টাতে হবে, লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে, বাজার সম্প্রসারণের দিক খুব ভালো ভাবে দেখতে হবে—এভাবে না এগোলে আমরা পরের ধাপে যেতে পারব না।

প্রথম আলো: একটা মানবিক বিজিএমইএ গড়তে আপনি কী করবেন? বিজিএমইএ মানবিক, এটা অনেকেই মনে করেন না।

রুবানা হক: আসলে নানা কারণে আমাদের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা থাকতে পারে। সবকিছুর পেছনেই যে কারণ আছে, তা না-ও হতে পারে। আমরা সব খারাপ কাজ করি, তা তো না। হয়তো একটা-দুটো বাজে উদাহরণের জন্য আমাদের পুরো খাত এর ফল ভোগ করে। আসলে একটা মানবিক বিজিএমইএ কেবল শ্রমিকের জন্য না, উদ্যোক্তার জন্যও হতে হবে। এমনকি মিডিয়ার জন্যও। তাঁরাও যেন এখানে এসে কোনো ভুল তথ্য না পান। সবাইকে যাতে বোঝাতে পারি, এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান আমরা তৈরি করতে চাই। আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অনেক নিষ্ঠার সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু যেহেতু একজন নারী সভাপতি হয়ে আসছি, আমার মনে হয় আশা জাগানোর সময় এখন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব, যাতে আমি মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসা আদায় করতে পারি। আমার বিশ্বাস, এটা আমি পারব। এই চেষ্টাটা আমি করে যাব।