অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের পরিণতি অশুভ

দেশপ্রেম কারও গায়ে লেখা থাকে না। দেশদ্রোহী হয়েও কেউ জন্মগ্রহণ করেন না। প্রতিদিন মানুষের দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে না। জাতির সংকটকালে একজনের নিঃস্বার্থ কর্মে প্রকাশ পায় তাঁর দেশপ্রেম। যাঁরা নিজের জীবন এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে একাত্তরে লড়াই করেছেন, তাঁরা জানতেন না যে তাঁদের স্বীকৃতির কোনো প্রয়োজন রয়েছে।

যুদ্ধ যখন হয় তখন একটা প্রতিপক্ষ থাকেই। বাংলাদেশের মানুষের শত্রুপক্ষ ছিল পাকিস্তানি সরকার, তাদের সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছিল কারও সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের। যে অবস্থান থেকেই যাঁরা যেভাবে তা করেছিলেন, তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ—এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সেনাবাহিনীর প্রথাগত যুদ্ধ নয়।

প্রথাগত সৈনিকেরা বেতন-ভাতা, পদক-পুরস্কার, প্রভৃতি পান। তা তাঁদের প্রাপ৵। কিন্তু জনযুদ্ধের মুক্তিসেনাদের কেউ বেতনের স্কেলের উল্লেখ করে কোনো নিয়োগপত্র দেন না, ইনক্রিমেন্টের উল্লেখ থাকে না, ভাতার বালাই নেই, প্রমোশনের প্রশ্ন ওঠে না। তাঁরা স্বনিয়োজিত এবং নিজ দায়িত্বে দেশমাতৃকার মর্যাদা রক্ষা করেন। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যাবেন কি না, সে চিন্তা করার অবকাশ তাঁদের থাকে না। চিন্তা তাঁদের একটাই: শত্রুর কবল থেকে দেশের মুক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল তা–ই। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জনগণের সঙ্গে যোগ দেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ করেন নতুন মাত্রা। তাঁদের থেকে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাঁদের বাইরে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের কর্মকর্তাদের থেকে ট্রেনিং ও অস্ত্র পেয়েছেন।

স্বাধীনতার পরপরই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার খুব প্রয়োজন ছিল, কারণ অনেক শহীদ পরিবারের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। তাদের সাহায্যের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। কিছুদিন পরে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁদের সে স্বীকৃতিও প্রাপ্য ছিল। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কম শিক্ষিত তরুণ, তাঁদের চাকরি দেওয়াও রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা উপযুক্ত—পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী ও সরকারি দপ্তরে তাঁদের নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার প্রয়োজন পড়ে। সেই তালিকা করার সময় চাকরিবাকরি কোনো কিছুর দরকার নেই—এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সরকার যখন তাঁদের দুটো ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন অনেকে সনদ নিতে আগ্রহী হন। তার পরেও অনেকে নেননি। দেশের জন্য কাজ করে রাষ্ট্র থেকে তার বিনিময়ে কিছু নিতে তাঁদের মন চায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রে অল্প কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের সন্তান। তাঁরা কিছু পেলেন না। রাষ্ট্রই সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করল।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা যতই বাড়তে থাকে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও ততই বাড়তে থাকে। অনেকটা যেন জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বেড়ে যায়। বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে হয়। এ পর্যন্ত ছয়বার তালিকা করতে হয়েছে। তাতেও শেষ হয়নি। এখন আবার নতুন তালিকার আয়োজন চলছে। এখন কে আসল আর কে ভুয়া, তা নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যখন চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক সুবিধার ব্যবস্থা হয়েছে, সুতরাং ভুয়াতে যে আসলেরা আড়ালে পড়ে যাবেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

জাতীয় জীবনের মহত্তম ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত থাকার গৌরব থেকে কেউই বঞ্চিত হতে চান না। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ঘটনায় যাঁর লেশমাত্র ভূমিকা নেই, সেই ব্যক্তি যখন ব্যক্তিস্বার্থে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেন, তখন তা শুধু প্রতারণা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মতো মহত্তম বিষয়কে অসম্মান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলা আরও বড় অপরাধ। ভুয়া পুলিশ কর্মকর্তা, ভুয়া সেনা কর্মকর্তা প্রভৃতি ধরা পড়লে জেলহাজত হয়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার শাস্তি আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অনবরত লেখা হয়। কোনো জাতির জন্য এ যে কত বড় গ্লানি! ‘মিথ্যা তথ্যে মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন/বাতিল হচ্ছে ১০২ সনদ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ (প্রত্যয়নপত্র) নেওয়ায় ১০২ মুক্তিযোদ্ধার (?) সনদ ও এ–সংক্রান্ত গেজেট বাতিল করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৯ জনই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বাকি ৪৩ জন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ এবং অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত শুনানির পর এঁদের সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। লাল মুক্তিবার্তায় নাম আছে এমন দুজনের সনদও বাতিল হচ্ছে।...এই সনদ ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টরা যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, সেগুলো বাতিল হবে কি না, তা গেজেট জারির পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ [যুগান্তর, ৩ এপ্রিল ২০১৯ ]

বাতিলওয়ালাদের নাম ও পদবিও দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ‘প্রজাতন্ত্রের সংস্থাপ্রধান, আয়কর কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসক, ব্যাংকার, পেশকার’ প্রভৃতি। ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিজীবনের ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা, এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ, স্থানীয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার পর ৫৯ জনের তালিকা তৈরি হয়।...চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্তত ছয় সচিব। ২০১৪ সালে তাঁদের সনদ বাতিল করা হলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

এ দেশে লঘু অভিযোগে অথবা কোনো অপরাধ ছাড়াই অনেকে বছরের পর বছর জেলের ভাত খাচ্ছেন। আর এত বড় জালিয়াতি ও প্রতারণার কোনো শাস্তি নেই! তাহলে এই প্রজাতন্ত্রে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান কোথায়?

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিয়ে এখন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ‘রাজাকারের তালিকা’ তৈরি করবে সরকার। দালালির অভিযোগে ’৭২-এ বঙ্গবন্ধুর সরকার যাঁদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করেছিল, তাঁরা সবাই রাজাকার। তাঁদের মধ্যে যাঁরা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ প্রভৃতি যুদ্ধাপরাধ ও ফৌজদারি অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের ছাড়া অন্যদের ক্ষমা করে দেন তিনি। এখন নতুন তালিকা কেন? মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রাপ্তিতে বড় রকমের লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। রাজাকারের তালিকা তৈরির উদ্যোগে আর একটি নতুন বাণিজ্যের দরজা খোলা হলে বহু নিরপরাধ মানুষ শুধু যে বিপন্ন হবেন, তা–ই নয়, তাঁরা সামাজিকভাবে যদি হেয় হন, তা হবে মানবতাবিরোধী কাজ।

প্রায় ৫০ বছর আগে যাঁরা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন এবং যাঁরা শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাঁদের বারো আনা আজ নেই। সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ব্যক্তি মেঠো বক্তৃতায় হাততালি পেতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিলে মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। একাত্তরসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের মীমাংসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যতটা সুষ্ঠুভাবে ও সাহসের সঙ্গে করতে পারবে, অন্য কোনো সরকার তা পারবে না। মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিতরণ ও রাজাকারের তালিকার প্রশ্নে সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ যেন তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে, জাতীয় সংহতির জন্যই তার বিকল্প নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক