নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত

ভারতে এই প্রথম সব ইভিএমের সঙ্গে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল)
ভারতে এই প্রথম সব ইভিএমের সঙ্গে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল)

ভারতের ১৭তম লোকসভা (জাতীয় সংসদ) নির্বাচন শুরু হচ্ছে। এবার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৫৪৩টি আসনে ৭ ধাপে। ১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত। ২৩ মে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হওয়ার কথা রয়েছে।

ভারতে এই প্রথম সব ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) সঙ্গে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ভিভিপিএটি (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল)। মোট ৯০ কোটি ভোটারের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। এ দায়িত্ব পালন করবেন প্রায় এক কোটি নির্বাচন কর্মকর্তা–কর্মচারী। ধারণা করা হচ্ছে, এই নির্বাচনে ১৭ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে। ভারতের তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে থাকে এবং এ পর্যন্ত সর্ববৃহৎ নির্বাচন পরিচালনা করতে যাচ্ছে।

১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত ভারতের নির্বাচন কমিশন ছিল এক সদস্যবিশিষ্ট: শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। প্রয়োজনে সাময়িকভাবে দুজন কমিশনার যুক্ত করা হতো। ১৯৮৯ সালে আইন সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের কাঠামো তিন সদস্যবিশিষ্ট করা হয়। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাবেক সচিব মি. সুনীল অরোরা। অন্য দুই কমিশনারের একজন প্রশাসন বিভাগের সাবেক সচিব অশোক লাভাসা, অন্যজন রাজস্ব বিভাগের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেসের সাবেক চেয়ারম্যান সুশীল চন্দ্র। নির্বাচন কমিশন রাজ্য পর্যায়ে ও ইউনিয়ন টেরিটরিগুলোতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার জন্য ৩৬ জন প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করে। তাঁরা প্রায় সবাই ভারতীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ সদস্য। রাজ্য সিইওর দায়িত্বে নিজ নিজ রাজ্যের লোক ও বিধানসভার নির্বাচন পরিচালিত হয়। সিইওদের জবাবদিহি শুধু নির্বাচন কমিশনের কাছে।

ভারতীয় রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা মনে করছেন, এবারের লোকসভা নির্বাচন এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্যতম কারণ গত নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো িতনি পূরণ করতে পারেননি। দুর্নীতি বহুগুণে বেড়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি, বেকারত্ব বেড়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার প্রয়াস প্রতীয়মান হয়েছে। কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে সেটাকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টায় রত। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রায় সমগ্র হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ভারতীয় কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করেছিল। কিন্তু গত চার বছর প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে বিজেপির জোট সরকারের অপশাসন ও হিন্দুত্ববাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির কারণে কংগ্রেসের পালে আবার হাওয়া লেগেছে।

মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেশ কমেছে, ফলে বিজেপি শঙ্কিত। সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আগে ব্যবহার করে ভোটার আকর্ষণের চেষ্টা করে খুব সফল হয়েছেন বলা যাবে না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বিজেপি সরকার নির্বাচন–সংক্রান্ত ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে সেগুলো সামলাতে হচ্ছে।

ভারতে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও ফলাফল নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। দেশটির নির্বাচন কমিশন ও তার নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে আফ্রো-এশিয়ান গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য আদর্শস্থানীয় বলে গণ্য করা হয়। পক্ষপাতহীনতা ও আইন প্রয়োগের বিষয়ে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনকে অতীতে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি।

তবে এবার নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি কর্মকাণ্ডে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন বিশেষজ্ঞের কেউ কেউ এবার ভোট গ্রহণের সাতটি ধাপের ব্যবস্থা করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন (২০১৪ সালে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল পাঁচ ধাপে)। প্রশ্ন উঠেছে বিশেষত সেই সব রাজ্যে, যেগুলোতে শাসক বিজেপি জোটের প্রভাব কম। উদাহরণস্বরূপ, ১১ এপ্রিল নির্বাচনের প্রথম ধাপে পশ্চিম বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্যে মাত্র ২টি আসনে (কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার) ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের এই দুই আসনে এখন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য আছেন। তবে দুটি অঞ্চলেই বিজেপি গত কয়েক বছরে বেশ শক্ত অবস্থান গড়তে পেরেছে। এ ছাড়া বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় কালক্ষেপণ করেছে এবং অবশেষে ১০ মার্চ রোববার (ছুটির দিনে) তফসিল ঘোষণা করেছে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারি খরচে নির্বাচনী সফর ও সংবাদমাধ্যমের কাভারেজ পাওয়ার বাড়তি সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এ ধরনের ছোটখাটো অভিযোগ আগেও উঠেছে। কিন্তু তাতে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার কাঠামো ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি।

ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিএম) জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরা সাধারণত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের কর্মকর্তা; তাঁদের তদারকিতে থাকেন সিইও। এত বড় ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কেন্দ্র থেকে পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ নেই, এমন মন্তব্য করেছেন একজন সাবেক কেন্দ্রীয় সচিব ও সাবেক নির্বাচনী সিইও এবং একটি নির্বাচনবিষয়ক সংস্থার প্রধান গবেষক।

ভারতের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ব্যাপকতা, কাঠামো ও ঐতিহ্যের কারণে পক্ষপাতিত্ব সম্ভব নয়। এসব সংস্থার উদ্দেশ্য ক্ষমতা ও আইনের প্রয়োগকারীদের নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে রাখা। ভারতের নির্বাচনকালে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনই যে নিয়ন্ত্রক, তা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সহযোগী এবং বিচার বিভাগ দেখাতে শুরু করেছে। কদিন আগে রাজস্থানের গভর্নর কল্যাণ সিংয়ের বিরুদ্ধে ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ লঙ্ঘন করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ভোট চেয়ে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সরকারকে গভর্নরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পত্র দিয়েছেন। এটি একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে কোনো রাজ্যপাল বা গভর্নরের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের অভিযোগ নজিরবিহীন। নির্বাচন কমিশন দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের করণীয় করেছে, এখন সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মোদি সরকারের জন্য এটি এক কঠিন পরীক্ষা। গভর্নর নিজে পদ থেকে সরে না দাঁড়ালে অথবা সরকার ব্যবস্থা না নিলে বিষয়টি সরকারের বিপক্ষে আদালতেও গড়াতে পারে।

ভারতীয় নির্বাচন কমিশন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে জবাব চেয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি নির্বাচনী প্রচারণাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘মোদিজির আর্মি’ বলেছেন। সেনাবাহিনীর তরফ থেকেও এর প্রতিবাদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এমনকি ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংসকারী মিসাইলের সার্থক পরীক্ষার পর নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণে আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে কি না, নির্বাচন কমিশন তা–ও খতিয়ে দেখছে। স্মরণযোগ্য যে ভারতের মডেল কোড অব কন্ডাক্ট কোনো আইন বা বিধি নয়, তথাপি এর ব্যত্যয় মামলাযোগ্য অপরাধ। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, ভারতের উচ্চ আদালতও নির্বাচনকে নিষ্কণ্টক করতে সহযোগিতা করে থাকেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মোদির জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র এই সময়ে যাতে প্রদর্শন না করা হয়, এ বিষয়ে কংগ্রেসের আরজি গ্রহণ করেছেন এবং ছবিটি প্রদর্শিত হয়নি। এর আগে বোম্বে হাইকোর্ট এই মামলা গ্রহণ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশনও এই ছবির নির্মাতাকে কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গের অভিযোগে জবাব তলব করেছে।

লোকসভা নির্বাচন ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ এনেছে; কমিশন এ পর্যন্ত সব চ্যালেঞ্জ দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। যদিও ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে আমাদের নির্বাচন কমিশনের মতো শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি ক্ষমতা নেই, তবু এ পর্যন্ত ভারতীয় নির্বাচন কমিশন অন্যান্য দেশের জন্য মডেল হয়ে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার শক্ত কাঠামো এবং আইন ও বিধি প্রয়োগের সংস্কৃতি। একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করলে যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার উন্নতির শিখরে উঠতে পারে, ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তার দৃষ্টান্ত। এবারের নির্বাচনের ফলাফল যা–ই হোক, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থায় কোনো ফাটল ধরবে না।

এই উপমহাদেশ, তথা উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন কমিশনগুলোর জন্য ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, আইনের প্রয়োগ ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা উদাহরণ হয়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শুধু কাগজে–কলমে নয়, ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের আস্থাভাজন হতে হয়।

. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]