ভাস্কো দা গামার দেশে আমাদের অর্জন

বাংলাদেশের ছাত্ররা এ বছর নিয়ে ২২ বছর ধরে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করছেন। এবার প্রতিযোগিতা ভাস্কো দা গামার দেশ পর্তুগালে। তিনি দুর্গম পথ অতিক্রম করে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করলেও তাঁর মাতৃভূমিতে যাওয়া আমাদের জন্য সহজ ছিল না। দূতাবাসই নেই, জানলাম ফরাসি দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করা যাবে। বাংলাদেশ থেকে দুটি দল শাহজালাল ও বুয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে শোনা গেল, ফরাসি দূতাবাস শাহজালালের দলকে ভিসা দেয়নি। এতে করে আমরাও ভয়ে ভয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জনাব খাস্তগীরকে বলে রেখেছিলাম। বুয়েটের ভিসা হলো গত ২৫ মার্চ, অনুষ্ঠান শুরু ৩১ মার্চ।

পর্যাপ্তসংখ্যক টিকিট একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে ছাত্রদের টিকিট কাটা হলো অনেক দাম দিয়ে। অনেক আগে টিকিট কাটতে পারলে কম দামে পাওয়া যেত। যা হোক, তুর্কি এয়ারলাইনসের একটি বিমানে করে ইস্তাম্বুল হয়ে বার্সেলোনায় পৌঁছালাম। এরপর পর্তুগিজ এয়ারলাইনসের বিমানে করে পোর্তো শহরে পৌঁছলাম মধ্যরাতে। বিমানবন্দরে সাধারণত স্বেচ্ছাসেবীরা থাকেন, থাকে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, তা কিছুই দেখতে না পেয়ে একটি নম্বরে ফোন করে বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তাই আয়োজকদের ডেকে নিয়ে এলেন। ঝামেলাহীনভাবেই পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট হোটেলে।

পর্তুগিজ জলদস্যুদের কথা বইতে পড়েছি, তাঁরা সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে আমাদের দেশের মানুষের সর্বস্ব লুট করে নিতেন। এখানে যাঁদের সঙ্গে দেখা হলো, তাঁদের মধ্যে এমন রক্ত প্রবাহিত হয় বলে মনে হলো না। যদিও হোটেল এইচএফ তুয়েলাতে রুম পাওয়ার কথা ৩১ তারিখ বেলা দুইটায়, আমাদের বেলা একটাতেই দিয়ে দেওয়া হলো, সঙ্গে সকালের নাশতার কুপনও। কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রুহুল আমিন সিদ্দিকের টেলিফোন কল পেয়ে আত্মবিশ্বাসে পদযুগল আকাশমুখী। এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের কর্মকাণ্ড আলাদা দৃষ্টিতে দেখছি।

আমাদের জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর উদ্যোগে ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের এই প্রতিযোগিতার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে। আমার দৃষ্টিতে এর থেকে বড় সম্মান আর নেই! তাই আয়োজনের যে দিকগুলোতে নজর দিতে হবে, তা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক প্রকৌশলী এনামুল কবিরের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। দলগুলোর প্রথম যখন আসার কথা, তার বেশ আগে থেকেই বিমানবন্দরে অভ্যর্থনার জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। এখানে দেখলাম, খাওয়ার সময় দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা, একটু পরে এলেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আমরা অতিথিদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করব না, সময়ের পরও আমরা কিছুটা সুযোগ রেখে দেব, যাতে বিদেশবিভুঁইয়ে আগত আগন্তুকদের কোনো অসুবিধা না হয়। প্রতিযোগিতার জন্য দলগুলো পাঁচ দিন অবস্থান করে। আমরা আগেভাগেই সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখব, যাতে অতিথিদের কোনো অসুবিধা না হয়।

গোটা আয়োজন আকফানডেগা নামের জায়গায়, ডৌরো নদীর পাশে। এই নদীতে একসময় নাকি রোমানরা অনেক সোনা রেখেছিল। নদীর ওপর দিয়ে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন সেতু, অনেক উঁচু দিয়ে, যার একটিতে ট্রাম চলাচল করে। শহরটিতে ছোট পাহাড়ি এলাকা রয়েছে।

রাষ্ট্রদূত ২ তারিখে এলেন, আমাদের অনেক সময় দিলেন, পোর্তো শহর খানিকটা ঘুরিয়েও দেখালেন, পরদিনও এলেন। এ দেশের জ্ঞানের চর্চা নিয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করানো যায়, তার চেষ্টা করছেন তিনি। স্থানীয় বাংলাদেশিদের নিয়েও তাঁর অনেক চিন্তাভাবনা। এগুলো শুনে খুবই ভালো লাগল যে আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূত দেশের স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, কীভাবে তার বিকাশ ঘটানো যায়, তার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

৩ তারিখে প্রতিযোগিতার রিহার্সাল হলো, আমাদের দল দুটি কম্পিউটার সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত হলো। ৪ তারিখের প্রতিযোগিতা শুরু হলো ৪টা ৫০ মিনিটে। পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দল প্রথম একটি সমস্যার সমাধান করে ফেলল। তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষিপ্রগতিতে অবাক হতে হয়। নয়টি করে দ্বিতীয় অবস্থানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, একইসংখ্যক সমাধান করে তৃতীয় অবস্থানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর রয়েছে ন্যাশনাল তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। ইরানের শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সাতটি সমাধান করে নবম অবস্থানে। কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড—উভয় বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ১৩তম স্থানে। আইআইটি মাদ্রাজ ও রুরকি বিশ্ববিদ্যালয় ৪১তম অবস্থানে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চারটি সমস্যার সমাধান করে ১৩৫টি দলের মধ্যে একাদশ স্থান দখল করেছে।

এই প্রতিযোগিতায় আমাদের সবচেয়ে ভালো ফল হলো মুনিরুল ও মুস্তাক ফেরদৌসের দলের আমেরিকার সব নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে একাদশ স্থান পাওয়া। এবার পৃথিবীর ৩ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ হাজার ছাত্র থেকে বাছাই করে ১৩৫টি দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রদূতের বিশেষ চেষ্টা না থাকলে শাহজালালের দলের অংশগ্রহণই অনিশ্চিত থাকত। অবশ্য এ অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা ভালো প্রস্তুতিও নিতে পারেনি।

আমাদের দেশে আজ থেকে প্রায় দুই বছর পর যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে, তার জন্য আমাদের অনেক প্রস্তুতি থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের দল যাতে সেখানে ভালো করতে পারে, তার জন্য প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার। আজকাল বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে যান। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রত্যয়ী সরকারকে অবশ্যই এই খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্ররা আমাদের দেশে আসবেন, আমাদের ছাত্ররা তাঁদের দেখে উদ্বুদ্ধ হবেন, তাঁরাও আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তির নানা উদ্যোগ দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি উচ্চ ধারণা নিয়ে দেশে ফিরবেন, এটা আমাদের সবার কামনা।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস