খয়রাতি শিক্ষা খয়রাতি জীবন

৬ এপ্রিল বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শিফটের ক্লাস শেষে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস শুরু হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় ১৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বাংলা বিষয়ের ক্লাস চলছিল। এ সময় বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কক্ষের ছাদের বিম ভেঙে কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর পড়ে।১০ জন শিক্ষার্থীর মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লাগে। গুরুতর আহত মানসুরা, সাদিয়া, ইসমাইল ও রুমাকে উদ্ধার করে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে মানসুরার মৃত্যু হয়। এটা কি প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের একদা চাওয়া ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’, নাকি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড? কেউ কেউ বলেছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে মাতম করার কোনো মানে হয় না। মানুষ মরণশীল, তার জীবন যেকোনো সময় থেমে যেতে পারে। মৃত্যুর জন্য বয়স লাগে না, অছিলা লাগে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এসব কথা কি নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়ে না? কেন এ ধরনের কথা বলা হয়? দায়িত্ব এড়ানোর উদ্দেশ্যে? গাফিলতি–অবহেলার মতো গুরুতর অপরাধ ঢেকে রাখার চেষ্টায়?

কার অবহেলা, কেন গাফিলতি–অনিয়ম

বিদ্যালয়টিকে এখন সংক্ষেপে পিকে স্কুল বলা হলেও আদতে এটার নাম পাতাকাটা (পিকে) নুরুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাত্র ২০০২ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগ পাঁচ কক্ষের বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করে। অভিভাবকেরা বলেছেন, শুরুতেই নিম্নমানের কাজ করায় ভবন ছিল নড়বড়ে। 

নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় ওই ভবনের বিমে ফাটল ধরে পলেস্তারা খসে পড়তে থাকে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্থানীয় সংবাদকর্মীদের বলেন, ভবনটি তিন বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায়। এই ভবনের নাজুকতার বিষয়টি তালতলী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি বিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করেননি। বাধ্য হয়ে ওই জরাজীর্ণ ভবনেই পাঠদান করতে হচ্ছিল।

অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, ভবনটির জরাজীর্ণ অবস্থা সম্পর্কে এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা প্রকৌশলীকে বারবার জানানো হলেও তিনি কর্ণপাত করেনি। এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী বলেছেন, ‘ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, এমন কথা আমাকে কেউ জানাননি।’ তবে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, সময়মতো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কী কী কারিগরি ত্রুটির কারণে বিম ধসে পড়েছে, তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও (ইউএনও) তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তদন্ত সাপেক্ষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ খবর ঠিকাদার কোম্পানির কানে পৌঁছালে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেতু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কবির উদ্দিন সাফ বলে দিয়েছেন, ‘আমার লাইসেন্স দিয়ে ওই বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করিনি। কে বা কারা করেছে আমি জানি না।’

কোম্পানিটির কি কোনো রাজনৈতিক ‘গডফাদার’ আছে? একজনের নামে বরাদ্দের কাজ কি আরেকজন করতে পারে? বন্দুক একজনের আর লাইসেন্স আরেকজনের কি হতে পারে? অবশেষে বরগুনার জেলা প্রশাসক তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (শিক্ষা) নেতৃত্বে চলবে তদন্ত, তাঁর সঙ্গে থাকবেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউএনও আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। কোনো অভিভাবক, কোনো জনপ্রতিনিধি, কোনো শিক্ষাবিদ বা কোনো শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই কমিটিতে নেই।

এ রকম জরাজীর্ণ ভবন কি আরও আছে?

জরাজীর্ণ, ব্যবহারের উপযুক্ত নয়, এমন বিদ্যালয় ভবনের তালিকা অনেক লম্বা। এসব নিয়ে বিস্তর সচিত্র লেখালেখি করেন জেলা–উপজেলার সংবাদকর্মীরা। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ছোটবালিয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের কথা প্রকাশিত হয়েছিল গত বছরের ২১ মে। ১৯৯৪ সালে নির্মিত এই বিদ্যালয় ভবনের একটিও দরজা, জানালা এখন আর অক্ষত নেই। ভবনের বাইরের অংশ দেখলে মনে হয়, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পলেস্তারা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। খসে পড়েছে দরজা–জানালা। পিলার ভেঙে বের হয়ে গেছে রড। একটু বাতাস কিংবা জোরে হাঁটাচলা করলে যে সামান্য কাঁপন হয়, তাতেই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে ছাদের ও দেয়ালের পলেস্তারা।

একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার কাকড়াবুনিয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুর্দশার কথা জাতীয় সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে। সেদিন ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র ইমরান হোসেনের ওপর বিদ্যালয়ের ছাদের ভারী পলেস্তারা খসে পড়লে তার হাত ভেঙে যায়, তার ১০ জন সহপাঠী আহত হয়। ইমরানের ভাগ্য ভালো, তার পরিণতি মানসুরার মতো হয়নি। তবে সারা জীবন তাকে আর তার সহপাঠীদের যে চরম নিরাপত্তাহীনতা তাড়া করে ফিরবে, তা–ও কম কষ্টকর নয়।

উত্তরের ছোট্ট জেলা জয়পুরহাটের ৩২টি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা আমরা জেনেছিলাম ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। তখন বলা হয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। তারপরও এসব বিদ্যালয় সংস্কারে বা পুনর্নির্মাণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গত বছরের ৯ জুলাই রংপুর মহানগরীর মুন্সিপাড়ার মরিয়ম নেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা চলাকালে ছাদের একটি অংশ ধসে দুজন পরীক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। নবম শ্রেণির ওই দুই ছাত্রীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

সে সময় রংপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শামসুজ্জোহা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বিদ্যালয়টির ভবনের ছাদের রডের টেম্পার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও সেখানে সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা হয়েছিল। ফলে ছাদের প্রায় ৮০-১০০ বর্গফুট আয়তনের একটি অংশ ধসে পড়ে। কার পয়সা বাঁচাতে কোন বিশ্বাসে শিশুদের জীবনের ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে কে কার পরামর্শে এমন কাজ করেছিল, সে প্রশ্নের উত্তর কি কেউ খুঁজবে কোনো দিন?

গত তিন মাসে দেশের নানা প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৫০ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলোর অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের যখন হাত ভাঙল, মাথা ফাটল, তখনো যদি আমাদের একটু হুঁশ হতো, তাহলে হয়তো মানসুরার লাশ দেখতে হতো না। এবার আমাদের হুঁশ ফিরুক।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক