সমুদ্র অর্থনীতি স্থবির কেন?

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কোনো বিরোধ বাংলাদেশ সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে চায় না। সেখানে এক বড় ব্যতিক্রম ছিল ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ। দেশ দুটির সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশ তা আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের এক সাহসী পদক্ষেপ। বাংলাদেশ এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারে, তা ভারত ও মিয়ানমার ভাবতেও পারেনি। অনেক আগ্রহী পাঠকেরই মনে থাকবে যে দেশ দুটি তখন এ নিয়ে হতাশা ও বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। দুটি ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বাংলাদেশের দাবির পক্ষে গেছে। আমরা একে সমুদ্র বিজয় হিসেবে উদ্‌যাপন করেছি এবং এক বড় সাফল্য বলে বিবেচনা করে থাকি।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে চূড়ান্ত হয় ২০১২ সালে, আর ভারতের সঙ্গে ২০১৪ সালে। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ‘ব্লু স্পেসের’ ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পর সাত ও পাঁচ বছর কেটে গেছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিজয়ের ফল কি আমরা এ পর্যন্ত ঘরে তুলতে পারলাম? বা তোলার পথে কতটুকু এগোলাম।

ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপের সরকারগুলো অর্থনীতির এক নতুন ফ্রন্ট হিসেবে সমুদ্রের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। এবং ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশের প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করছে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি এখন সমুদ্র অর্থনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দেখা যাচ্ছে খাদ্য, খনিজ, জ্বালানি ও ওষুধের উপাদানের উৎস হিসেবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরতা দিনে দিনে বাড়ছে। সমুদ্র ও এর সম্পদকে কতভাবে ও কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে দেশে দেশে দক্ষযজ্ঞ চলছে। আর বন্দর ও জাহাজশিল্প, সমুদ্র পরিবহন এবং সমুদ্র ও উপকূলীয় পর্যটনের মতো প্রচলিত সমুদ্রনির্ভর বাণিজ্য তো রয়েছেই।

সমুদ্র ও এর সম্পদ নিয়ে এত মাতামাতির মধ্যে এটাও এখন বড় বিবেচনার বিষয় যে সমুদ্রের এই সম্পদ অফুরন্ত নয়। এ নিয়ে যথেচ্ছাচার চলবে না। এর সঙ্গে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে পরিকল্পিত, সমন্বিত ও সতর্ক উদ্যোগের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ২০১৮ সালে ‘টুয়ার্ডস এ ব্লু ইকোনমি: এ পাথওয়ে ফর সাসটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।

সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্তেরও বড় আকাল রয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন সূত্র থেকে যা পাওয়া গেছে, তা জড় করে বিশ্বব্যাংক একটি হিসাব করেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্লু ইকোনমির অবদান (বা গ্রস ভ্যালু এডেড) ছিল ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বা মোট অর্থনীতির ৩ শতাংশ। কোন খাত সমুদ্র অর্থনীতিতে কতটা ভূমিকা রেখেছে, তারও একটি হিসাব রয়েছে; পর্যটন ২৫ ভাগ, সমুদ্র থেকে মাছ ধরা এবং অ্যাকুয়াকালচার ২২ ভাগ ও তেল-গ্যাস সম্পদ ১৯ ভাগ। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে হিসাবটি করা হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে সমুদ্রে বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু থেকে গ্যাস তোলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র অর্থনীতিতে তেল-গ্যাস খাতের ভূমিকা এখন শূন্য।

‘সমুদ্র বিজয়’ নিয়ে যে মাতামাতি হলো, তারপর সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে যে গতিতে এগোনো উচিত ছিল, বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ নামে একটি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক সেল গঠন ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু এই সেলের হাতে কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই। তাদের সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এসব বিবেচনায় সংসদীয় কমিটি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে সেলের বদলে আইনগত ক্ষমতা দিয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছিল। এরপর প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে, কোনো ফল মেলেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৪ ও ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুটি ওয়ার্কশপ করে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাব্য ২৬টি খাত চিহ্নিত করেছে। ব্যাস, ওইটুকুই।

সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর তেল-গ্যাস সম্পদের বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে। কারণ এই অঞ্চলের সমুদ্রে বড়সড় মজুত রয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ‘সমুদ্র বিজয়’-এর পর দেখা গেল মিয়ানমারই দ্রুততার সঙ্গে এর ফল ঘরে তুলতে শুরু করল। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধের নিষ্পত্তির বছর দুয়েকের মাথায় শুধু গ্যাসের মজুত আবিষ্কার নয়, বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তোলাও শুরু করে দিয়েছে মিয়ানমার। সেই গ্যাস নিজেরা ব্যবহার করছে, রপ্তানি করছে চীনে। তাদের অধিকাংশ ব্লকে অনুসন্ধানের কাজ চলছে। কারণ, বিরোধ মেটার আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ভারতও বসে নেই। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশে দেশটির সরকারি ও বেসরকারি তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো জোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে ও বিপুল মজুতের আশা করছে।

আর এ ক্ষেত্রে আমাদের আগাম প্রস্তুতি তো ছিলই না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির পরও আমাদের টনক নড়েনি। সমুদ্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর ২৬টি নতুন ব্লকে বিন্যাস করে এর মধ্যে ১১টি অগভীর ও ১৫টি গভীর সমুদ্রের ব্লক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর বহু সময় কেটে গেছে। ২০১৯ সালের সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, মাত্র ৪টি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু একটি কূপও আমার খনন করতে পারিনি। বাকি ২২টি ব্লক স্থবির পড়ে রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে উৎপাদন ও ভাগাভাগি চুক্তির আগে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে হবে কি হবে না—সেই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই আমরা এখনো আটকে আছি। অথচ ২০১৪ সালই মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করার উদ্যোগ ও সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। এবং তা এত দিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। দেশে জবাবদিহির সংস্কৃতি থাকলে কেন কাজটি হলো না এবং এর পেছনের রহস্য কী, তা খোলাসা করতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলাকে বাধ্য করা যেত।

জ্বালানির সংকটে বিপদে আছে দেশের শিল্প খাত। অথচ দেশের সমুদ্রের ব্লকগুলোতে জ্বালানি অনুসন্ধানের উদ্যোগ বছরের পর বছর ধরে স্থবির হয়ে রয়েছে। মিয়ানমার যেখানে গ্যাস রপ্তানি করছে, সেখানে ঘাটতি সামাল দিতে আমরা গ্যাস তরল করে (এলএনজি) জাহাজে ভরে আমদানি করছি। আবার দামি এলএনজি প্ল্যান্ট বসিয়ে তাকে রূপান্তর করছি। দেশের গ্যাসের চেয়ে এর খরচ পড়ছে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।

সমুদ্র বিজয় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তাকেও এই দীর্ঘ পাঁচ-সাত বছরে কাজে লাগানো যায়নি। আমাদের মাছ ধরার ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৭০ কিলোমিটারের বেশি গভীরে গিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে পারে না। এর বাইরে আরও সাড়ে ৬০০ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চল আমাদের মাছ ধরার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কিছু উদ্যোগ ও প্রস্তাব সম্প্রতি অনুমোদন পেয়েছে। এর জন্য এত বছর অপেক্ষার জবাব কী?

সমুদ্র বাণিজ্যের যে ২৬ খাত চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে তেল-গ্যাস ছাড়াও নানামুখী পর্যটন, বন্দর, জাহাজশিল্প, সমুদ্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি (বাতাস ও স্রোত) ও সমুদ্র সম্পদ ও খনিজনির্ভর শিল্পসহ নানা কিছু রয়েছে। এই খাতগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই ও কীভাবে এগোতে হবে বা কোনটিকে প্রাধান্য দিতে হবে, তার পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু সমুদ্র অর্থনীতি পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে বা এমন বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকলে যে কাজ হয় না, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্ষুদ্র একটি ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ দিয়ে চলবে না। আইনগত ক্ষমতাসহ একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। পৃথক ‘সমুদ্র সম্পদ মন্ত্রণালয়’ দরকার বলেও মনে করেন অনেকে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সমুদ্র অর্থনীতির জোরালো ভূমিকা চাইলে সেই দিকেই যেতে হবে।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
[email protected]