'২০টি মডেল ভবন তৈরি করে দেখান'

পরপর কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত
পরপর কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত

পরপর কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় একদিকে মানুষের মনে যেমন ভয় ঢুকেছে, অন্যদিকে মনে হয় একটু আশার আলোও জেগেছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, এভরি ক্রাইসিস ইজ অ্যান অপরচুনিটি। মানে, ভয়াবহ সংকট দেখা দিলে তার সমাধানের পথও বের হয়। ৭ এপ্রিল প্রথম আলো ও শেল্টেকের উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এমন কিছু কথা বলেছেন, যার মধ্যে ভবিষ্যতের ঢাকা নিয়ে আতঙ্ক ও হতাশা থাকলেও আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু প্রত্যয়ও ছিল।

নিশ্চয়ই কেউ কেউ ভাবছেন, ঢাকার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এখানে একের পর এক ভবন, বস্তি, বাজারে আগুন লাগবেই, আর মানুষ মরবে অসহায়ভাবে। এটা কপালের লিখন। এর পরিবর্তন কঠিন। কারণ, এখানে নীতিমালা থাকলেও কেউ মানে না। কর্তৃপক্ষের তদারকিও তেমন থাকে না। সমঝোতার মাধ্যমে বেআইনি অনেক কিছুই করা সম্ভব। প্রভাবশালীদের চোখরাঙানির চাপে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মীরা থাকেন তটস্থ। এই অবস্থায় আমাদের বারবার পুড়ে মরতেই হবে।

কিন্তু এই পোড়া কপাল কখনো বদলাবে না, এমন কথা বলা যায় না। কারণ, আমাদের চোখের সামনেই তো দেখলাম, সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৪ জনের প্রাণহানি এবং আরও হাজার দুয়েক মানুষ আহত হওয়ার পর গত ছয় বছরে তৈরি পোশাকশিল্প খাত আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানের পোশাক তৈরির সক্ষমতা অর্জনের ফলে। একই সঙ্গে দেখেছি অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে শুধু নিরাপদ ও মানসম্পন্ন কারখানার জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণে (কমপ্লায়েন্ট) ব্যর্থতার কারণে।

সেদিন আলোচনায় ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বললেন, রানা প্লাজার ভয়াবহ ভবনধস যদি আমাদের গার্মেন্টস শিল্প বাঁচাতে শুধু না, বরং আরও এগিয়ে যেতে শিখিয়ে থাকে, তাহলে বনানীর এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনাও আমাদের নিরাপদ ভবনের নিশ্চয়তা হয়তো দিতে পারবে।

তবে পার্থক্য হলো, নিরাপদ ভবনের জন্য আমাদেরই কাজ করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের বেলায় সহযোগিতা দিয়েছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সসহ বিদেশি ক্রেতাদের উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের আবাসন ভবনের নিরাপত্তায় তো বাইরের উদ্যোগের প্রশ্ন আসে না। আমাদেরটা আমাদেরই করতে হবে এবং সেটা খুবই সম্ভব।

কীভাবে? আচ্ছা, দেখুন, বিটিআইয়ের (বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড) ম্যানেজিং ডিরেক্টর এফ আর খান তো বেশ জোর দিয়েই বললেন, আগুন লাগলে উঁচু ভবন থেকে ৪৫ মিনিটে ৩৫০ জনকে নিরাপদে নামিয়ে আনা সম্ভব। নিরাপদে বের হওয়ার জন্য উঁচু ভবনের বাইরের দিক ঘেঁষে শক্ত স্টিলের সিঁড়ি থাকলেই অনেক সহজে বেরিয়ে আসা যায়। এমন ব্যবস্থা যেকোনো ভবনে করা সম্ভব। যদি এ ধরনের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে সেদিন বনানীর এফ আর টাওয়ারে তো একজন মানুষকেও জীবন দিতে হতো না। যে ত্রুটিগুলো ছিল, তা দূর করা মোটেই কঠিন নয়। এই যেমন, ফায়ার এক্সিট থাকলেও সেটা ছিল বন্ধ। কোনো কোনো তলায় সিঁড়ির পথে কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আরও অনেক অনিয়ম। ১৮ তলা ভবনের অনুমতি থাকলেও ২৩ তলা ভবন বানানোর অভিযোগ উঠেছে। ভবন নির্মাণের এই কালো অধ্যায় এখনই বন্ধ করতে হবে।

এখন আমাদের শিক্ষা হওয়া দরকার। বাঁচতে হলে নিয়ম মানতে হবে। শুধু রাজউক নয়, তার সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রতিটি নির্মাণ এলাকায় তদারকি দল থাকতে হবে। এলাকাবাসীরও সেই দলে ভূমিকা রাখা দরকার। কারণ, আগুনে শুধু একটা ভবন নয়, আশপাশের সব ভবনই ঝুঁকিতে পড়ে।

আর তা ছাড়া ছোট-বড় সব ভবনেই আগুন নেভানোর হালকা যন্ত্র প্রতি তলায় রাখা খুবই সম্ভব। বড় ভবনগুলোতে তো দিনরাত সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকে। ফায়ার অ্যালার্ম বাজলে সিকিউরিটি সদস্যরা আগুন নেভানোর যন্ত্র দিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করবেন। এর মধ্যে এসে যাবে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।

ঢাকা মহানগরে আমরা একটি ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির ওপর বাস করছি। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন আমাদের এই কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার যেন কোথাও আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে অন্তত গ্যাসলাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যুতে এ ব্যবস্থা আছে। সার্কিট ব্রেকার খুব দরকার।

এখন বাসায় বাসায় আরেক বিপদ। পাইপলাইনে গ্যাস দেওয়া বন্ধ। তাই ফ্ল্যাটে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সিলিন্ডারগুলো অনেক ক্ষেত্রে জরাজীর্ণ। নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় না। হয়তো বড় ভবনের নিচতলায় গ্যারেজের এক কোনায় সারি সারি সিলিন্ডার। যদি একটা বিস্ফোরিত হয়, তাহলে পুরো বাড়ি উড়ে যেতে পারে। এই বিপদ সম্পর্কে এখনই সতর্ক হতে হবে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল একটা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা আমাদের ভাবতে হবে। এ মুহূর্তে দেখতে হবে, সব ভবনে বিপদে-আপদে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি আছে কি না। আগুন নেভানোর ন্যূনতম যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) রাখতে হবে। এটা দ্রুতই নিশ্চিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করা। যেন এ বিষয়ে দেশে যথেষ্টসংখ্যক বিশেষজ্ঞ থাকেন।

দেশে একটা আইন আছে। সব ভবন নির্মাণের পর রাজউক থেকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হবে। এটা অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেটা সহজ প্রক্রিয়ায় পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকলে সহজে কেউ সোজা পথে যেতে চাইবে না। আইনের এই দিকটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মেয়র আতিকুল ইসলাম একটি লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘২০টি মডেল ভবন তৈরি করে দেখান, আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেয়াত দেব। আর যারা আইন-নীতিমালা ভেঙে ভবন নির্মাণ করবে, তাদের শাস্তি পেতে হবে।’

মডেল কিন্তু আছে। আমাদের এই ঢাকা মহানগরেই বেশ কিছু উঁচু ভবন সব নিয়মবিধি মেনে তৈরি করা হয়েছে। শেল্টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক এম সেরাজ বললেন, মিরপুর মাজার রোডে তাঁদের শেল্টেক্ বীথিকা হাউজিং কমপ্লেক্স একটি দৃষ্টান্ত। এ রকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বহুতল ভবন ঢাকায় এখন গড়ে উঠছে। এরাই নিরাপদ আবাসনের পথ দেখাবে।

নগর সরকারের কথাটি ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। নগর–পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বললেন, নগর ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষভাবে উত্তর ও দক্ষিণ—দুই সিটি মেয়রের সমন্বিত একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তাঁদের সিদ্ধান্ত সহজে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকলে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।

আমরা এখন আশায় থাকব, ধীরে ধীরে নিরাপদ ঢাকা নিশ্চিত করা হবে। অন্তত আগুনে আর মরতে হবে না।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]