গণতন্ত্র এখনো অনেক দূরে

ফাইল ছবি।
ফাইল ছবি।

আজ থেকে আট বছর আগে শকুন চোখ রেখেছিল দেশটির সম্পদের ওপর। মৃতদেহ ভক্ষণের জন্য শকুনের দরকার ছিল দেশের ভেতরে হানাহানি উসকে দিয়ে পথেঘাটে নিজের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করে নেওয়া। আমরা জানি, একালের শকুনের খাদ্য মৃতদেহ নয়, বরং মাটির নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তেলসম্পদ। তবে সেই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে হলে আকাশে চক্কর দিতে থাকা একালের শকুনেরও দরকার হয় মৃতদেহ, বিশেষ করে সম্পদ যারা পাহারা দিয়ে রাখছে, তাদের নশ্বর দেহ। গণতন্ত্র আর মুক্ত হাওয়ার নামে ঠিক সেই কাজটিই করেছিল আকাশের ওপর পাক দেওয়া অবস্থায় নিচে তীক্ষ্ণ নজর রেখে যাওয়া শকুনের দল।

অন্যদিকে দেশটির সেই সময়ের নেতা মাথার ওপরে আর নিচে মাটিতে চলতে থাকা অদ্ভুত সেই খেলার ভেতরের কারসাজি আঁচ করতে পেরেই নিচের দলটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ইঁদুর আর তেলাপোকা হিসেবে। ফলে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে জীবন দিতে হয়েছে মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা শকুন আর নিচে শকুনের মদদপুষ্ট ইঁদুর আর তেলাপোকার হাতে। নিচের সেই ইঁদুর আর তেলাপোকার দল মনে করেছিল খেল খতম হলে শকুনের বদান্যতায় তারা ফায়দা ঠিকই লুটে নেবে।

এরপর পার হয়ে গেছে দীর্ঘ আট বছর। গণতন্ত্র আর মুক্ত হাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মাথার ওপরের শকুনের দল দেশটির পূর্বাঞ্চলের তেলসম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিশ্চিত করে নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আকাশে বিলীন হয়ে গেলে পরের খেলাটি শুরু হয় নিচে থেকে যাওয়া ইঁদুর আর তেলাপোকার মধ্যে। হঠাৎ করেই এদের বোধোদয় হয় যে আসলেই এরা প্রতারিত হয়েছে শকুনের হাতে। আর তখন নিজেদের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় মারামারি আর খুনখারাবি, একসময়ের বিত্তশালী দেশটিকে যা এখন করে দিচ্ছে একেবারে লন্ডভন্ড।

লিবিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রতীকী ব্যাখ্যা মনে হয় এভাবেই দেওয়া সম্ভব। আট বছরে শেষ হয়নি দেশজুড়ে চলতে থাকা হানাহানি। সেই সুবাদে কখনো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে পূর্বাঞ্চলের কিছু শক্তিশালী দস্যু দল, কখনো আবার ক্ষমতার পাল্লা ঝুঁকে পড়েছে পুবের দস্যুদের মদদপুষ্ট লুটেরাদের দিকে।

কোনো একটি দেশ কিংবা অঞ্চলে যখন এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, সে রকম পরিস্থিতির সুযোগ নিতে সব সময় তখন দেখা যায় বিশেষ কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হতে। লিবিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। গত সাত বছরে ক্ষমতার ভারসাম্যের নানা রকম রদবদলের নাটক মঞ্চায়িত হতে থাকা অবস্থায় কখনো দেখা গেছে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গ্রুপকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে, কখনো মাথা চাড়া দিয়ে নিজেদের পেশি-বলের আওয়াজ দিয়েছে দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাকামীরা, কখনো আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে রাজধানী ত্রিপোলিভিত্তিক পশ্চিমের মদদপুষ্টরা। ক্ষমতার ভারসাম্যের এই রদবদলের খেলায় বল এখন যার পায়ে, তিনি হলেন পূর্বাঞ্চলের সমর নায়ক খলিফা হিফতার, দূর অতীতে একসময় যিনি ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছের মানুষ।

১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশ চাদে লিবিয়ার চালানো সামরিক অভিযানের সময় চাদের সেনাবাহিনীর হাতে জেনারেল হিফতারের ধরা পড়ে যাওয়া তাঁর ভাগ্যের চাকা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। গাদ্দাফি প্রতিবেশী দেশে সামরিক অভিযান চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে সব দোষ হিফতারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে তাঁর একসময়ের এই কাছের মানুষটি পশ্চিমে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং সেই অনুমতি মিলে গেলে তিনি আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ল্যাংলিতে অবস্থিত সিআইএর সদর দপ্তরের কাছাকাছি জায়গায়। গাদ্দাফির পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানেই তিনি ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। শকুনের বদান্যতায় সেই সুযোগ মিলে যাওয়ায় তড়িঘড়ি দেশে ফিরে গিয়ে নেতৃত্বহীন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে শক্ত-মানবরূপে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন।

তখন থেকেই গৃহযুদ্ধ আর হানাহানি চলতে থাকা দেশটিতে কখনো ত্রাতার ভূমিকায়, কখনো দস্যু-সরদার হিসেবে, কখনো আবার সমরনায়কের বেশে তাঁর চমকপ্রদ আবির্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁর সর্বশেষ ভূমিকা হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের তোবরুক শহরভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই সরকারের সমরনায়ক হিসেবে নিজের বাহিনী নিয়ে ত্রিপোলির ওপর চড়াও হয়ে সেখানে জাতিসংঘের স্বীকৃত সরকারকে গদিচ্যুত করার খেলায় মত্ত হওয়া। সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে তিনি এখন এগিয়ে চলেছেন। এর পরিণতি কী হতে পারে, তা বলা মুশকিল। কেননা, ২০১১ সালের পর থেকেই দেশটি কার্যত দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, তেলসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চল, যেখানে পশ্চিমে ক্ষমতাসীন সরকারের কথা শুনতে নারাজ। এদিকে জাতিসংঘ চাইছে যত দ্রুত সম্ভব তড়িঘড়ি একটি নির্বাচনের আয়োজন শেষ করে নিয়ে আইনগত সব রকম নিয়মকানুনের বাইরে চলে যাওয়া দেশটি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে। তবে হিফতারের হিসাব অবশ্য অন্য রকম।

ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের পরাভূত করে নিজের সমরশক্তির পরিচয় হিফতার আগেই দিয়েছেন। ফলে তখন থেকেই তাঁর নজর ত্রিপোলির দিকে। নির্বাচনের আয়োজন জাতিসংঘ করে ফেলতে পারলে ক্ষমতায় বসা তাঁর পক্ষে সম্ভব না–ও হতে পারে। অন্যদিকে শকুন শুষে নেওয়ার পরও তেলসম্পদের উচ্ছিষ্ট যা রয়ে গেছে, সেটা এখন তাঁর হাতে। সেই অর্থবল তাঁকে দিয়েছে নতুন মিত্রের সন্ধান এবং সিআইএর সদর দপ্তর ল্যাংলির একসময়ের অনুগত এই ব্যক্তি এখন রাশিয়া ও সেই সঙ্গে মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছের মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। ফলে লিবিয়ার এই হানাহানি যে সহজে শেষ হওয়ার নয়, সেই হিসাব হয়তো অন্যদিকে সহজেই করে নেওয়া সম্ভব।

মাথার ওপর শকুনের চক্কর দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য লিবিয়ার মানুষের আঁচ করতে না-পারা থেকে দেশটির সংকটের সূচনা। প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র দেশটির জন্য এখনো অনেক দূরের বিষয়। তবে শকুন কিন্তু অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়নি। কেননা, শকুনের জানা আছে খাদ্যের প্রাচুর্যে ভরা এলাকাটিতে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া অনেক বেশি সহজ।

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক